এই লেখাটি যখন পড়ছেন, তখন ইতোমধ্যেই নিশ্চয়ই জেনে গেছেন, অার্জেন্টিনা ও অাইসল্যান্ডের মধ্যকার খেলার ফলাফল। জেনেছেন ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাসে অার্জেন্টাইন সুপারস্টার মেসিকে ট্র্যাজিক হিরো হয়ে পুড়তে হচ্ছে অাক্ষেপের অাগুনে। ভাগ্যের সেই নির্মম পরিহাসের নাম পেনাল্টি মিস।
তবে মেসি এই ট্র্যাজিক হিরোদের দলে একা নন। তার অাগে অনেক রথী মহারথীই এসেছেন, যারা চরম উত্তেজনাকর এই মুহূর্তে নিজের নাম কিংবা খ্যাতির ওপর সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের কয়েকজনের কথা অাজ জেনে অাসা যাক।
৫. অাসামোয়াহ জিয়ান (ঘানা বনাম উরুগুয়ে, ২০১০)
২০১০ অাফ্রিকা বিশ্বকাপের উরুগুয়ে ও ঘানার মধ্যকার এই কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচটি বেশ কিছু কারণে স্মরনীয় করে রাখবার মতো। বিশেষ করে সেবারই প্রথম কোন অাফ্রিকান দল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বের বাধা পেরিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। প্রতিপক্ষ শক্তিমত্তার বিচারে অনেক বেশি এগিয়ে থাকা উরুগুয়ে।
নির্ধারিত সময়ে ১-১ ব্যবধানে খেলা শেষ হয় এবং ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়ায়। যখন অতিরিক্ত সময়েও কেউ গোল করতে পারছিলো না, তখন সবাই ধরে নিয়েছিলেন খেলা টাইব্রেকারেরর দিকে গড়াতে যাচ্ছে। কিন্তু একশ বিশ মিনিটের মাথায় ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ঘানার একটি শট গোলপোস্ট ঢুকবার মুহূর্তে উরুগুয়ের স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজ তা হাত দিয়ে রুখে দেন। সুয়ারেজকে লালকার্ড দেখি বহিস্কার করা হয় এবং ঘানা পেনাল্টি পায়। সবাই তখন ধরেই নিয়েছে ঘানা প্রথম অাফ্রিকান দল হিসেবে সেমিফাইনালে জায়গা করে নিতে চলেছে।
কিন্তু সবার সে অাশায় গুড়েবালি হয়ে যায়, যখন পেনাল্টি নিতে অাসা অাসামোয়াহ জিয়ানের শটটি ক্রসবারে লেগে ফেরত অাসে। অগত্যা খেলা টাইব্রেকার গড়ায় এবং নতুন ইতিহাস গড়ার পরিবর্তে ব্যর্থ মনোরথে ঘানাকে বিশ্বকাপ থেকে ফিরতে হয়।
ম্যাচ শেষে জিয়ান বলেন, “অামি বলবো, সুয়ারেজ তার দেশের কাছে একজন নায়ক। কারণ বলটি যখন ঢুকে যাচ্ছিলো, তখন সে তা হাত দিয়ে ঠেকায়। তাই এখন সে তার দেশের একজন নায়ক।”
৪. মিশেল প্লাতিনি (ফ্রান্স বনাম ব্রাজিল, ১৯৮৬)
অাশির দশকে সেরা ফুটবলার কে, এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করলে গোটা ইউরোপ জুড়ে কেবল একটি নামই ধ্বনিত হয়। অার তা হলো মিশেল প্লাতিনি। অার হবেই না বা কেন! ১৯৮৪ সালের ইউরোতে ফ্রান্সকে একক প্রচেষ্টায় চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলেন তিনি।
১৯৮৬ সালে ইনজুরিতে পড়ে প্লাতিনি নিজেই নিজের ছায়াতে পরিণত হন। তবুও তিনি লেস ব্লুজদের অাক্রমণভাগে সুযোগ পান। সেবারের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্স ব্রাজিলের মুখোমুখি অবতীর্ণ হয়। নির্দিষ্ট সময়ে কেউ গোল করতে না পারায় খেলা টাইব্রেকারে গড়ায়। ব্রাজিল তাদের প্রথম পেনাল্টি মিস করে।
প্লাতিনি যখন শুট নিতে অাসেন, তখন তার সামনে ৪-৩ ব্যবধানে এগিয়ে নেবার সুযোগ উন্মুক্ত। কিন্তু প্লাতিনির শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং খেলা পেন্ডুলামের মতো দুলতে শুরু করে।
সৌভাগ্যবশত ব্রাজিল এর পরের শটটি মিস করে ও ফ্রান্সের লুইজ ফার্নান্দেজ গোল করে ফ্রান্সের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ফ্রান্স ম্যাচটি জিতে নেয়ায় প্লাতিনির পেনাল্টি মিস নিয়ে খুব একটা অালোচনা হয়নি, তবে এটি যে তার জীবনে একটি অাক্ষেপ হয়ে থাকবে সেব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
৩. জিকো (ব্রাজিল বনাম ফ্রান্স, ১৯৮৬)
১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের ব্রাজিল-ফ্রান্স ম্যাচটি যে শুধু প্লাতিনির জন্য অাক্ষেপের হয়ে থাকবে তা কিন্তু নয়। এই ম্যাচটি অনুশোচনার অাগুনে দগ্ধ করবে অারো একজন কিংবদন্তীকে। তিনি হলেন ব্রাজিলের জিকো।
বহুল অালোচিত সেই পেনাল্টি শুটঅাউট বা ট্রাইবেকারেরও অাগের ঘটনা এটি। ম্যাচের ৭৩ মিনিটের কথা। খেলা তখন ১-১ এ সমতায়। হঠাৎ করেই ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় ব্র্যাংকোকে ডি-বক্সের ভেতর ফেলে দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে ব্রাজিল পেনাল্টি পেলো। জিকো কিছু মিনিট অাগেই রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে উঠে এসেছেন। তবুও ন্যাচারাল স্ট্রোকমেকার হওয়ায় পেনাল্টি কিক নেয়ার দায়িত্ব তার ওপরই বর্তালো।
জিকো শট নিলেন। কিন্তু লেস ব্লুজ গোলরক্ষক জোয়েল বেটস সেই শট অসামান্য দৃঢ়তায় রুখে দিলেন। এই পেনাল্টি মিসের মাধ্যমে সেলেকাও-দের যে দূর্ভাগ্যের সূচনা হলো তার পরিসমাপ্তি ঘটলো টাইব্রেকারে পরাজয়ের মাধ্যমে।
২. ডেভিড ট্রেজেগুয়েট (ফ্রান্স বনাম ইতালী, ২০০৬)
২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপ ফাইনাল সকল উত্তেজনার পারদ অতিক্রম করে ফেলে, যখন একশ বিশ মিনিটের খেলা অমীমাংসিত ভাবে শেষ হয় এবং তা টাইব্রেকারে গড়ায়। যেহেতু এটা পেনাল্টি শুটঅাউট, তাই ফলাফল নির্ধারণের খাতিরে কাউকে না কাউকে শুটঅাউট মিস করতেই হবে। কিন্তু ডেভিড ট্রেজেগুয়েট-ই যে সেই বলির পাঠা হবেন, এটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি।
জুভেন্টাসের ট্রেজেগুয়েটকে সেসময়কার ইউরোপের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে গণ্য করা হত। তিনি যখন শুট নিতে অাসেন, তখন স্কোরকার্ডে ইতালি ২-১ এ এগিয়ে। সবাই ভেবেছিলো ট্রেজেগুয়েট গোল করে ফ্রান্সকে সমতায় ফিরিয়ে অানবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তার জোরালো শটটি ক্রসবারের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়।
ইতালি সুবিধাজনক অবস্থায় চলে অাসে। দলের বাকিরা নিজ নিজ পেনাল্টি কিক থেকে সফল ভাবে গোল করতে সক্ষম হলেও ট্রেজেগুয়েটের লক্ষ্যভ্রষ্ট শটটির কারণে ফ্রান্সের এক শট বাকি থাকতেই ইতালি ৫-৩ ব্যবধানে জিতে নেয় বিশ্বকাপ। সেই সাথে তীরে এসে তরী ডুবে ফ্রান্সের।
১. রবার্তো ব্যাজিও (ইতালী বনাম ব্রাজিল, ১৯৯৪)
সম্ভবত পেনাল্টি শুটঅাউটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঘটনটি ঘটেছিলো ১৯৯৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে। রবার্তো ব্যাজিও একক নৈপুণ্যে ইতালী সেবার ফাইনালে উঠে। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ব্রাজিল। উভয় দলের সামনেই সুযোগ নিজেদের চতুর্থ শিরোপা জিতে নেবার। ব্যর্থ অাক্রমণ ও পাল্টা অাক্রমণের কারণে গোলশুণ্য অবস্থাতেই নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময়ের খেলা শেষ হয় এবং খেলা যথারীতি টাইব্রেকারে গড়ায়।
অবাক করা ব্যাপার হলো, ইতালিয়ান অধিনায়ক ব্যারেসি ও ব্রাজিলের সান্তোস নিজেদের ও দলের প্রথম পেনাল্টি কিক মিস করেন। একপর্যায়ে খেলা সাডেন ডেথ-এ গড়ায়। খেলা তখন চরম উত্তেজনাকর মুহূর্তে। খেলায় টিকে থাকতে হলে অবশ্যই গোল করতে হবে। এমন সময় শট নিতে অাসলেন ব্যাজিও। সবার অপলক দৃষ্টি ব্যাজিওর দিকে নিবদ্ধ। একটি মাত্র শট। যেটি সফলভাবে নিতে পারলেই অাজ্জুরীরা রচনা করবে নতুন ইতিহাস।
ব্যাজিও শট নিলেন। বড় জোরালো সে শট। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! ইতালির ইতিহাসে সবচেয়ে নিখুঁত শট নিতে পারার খেতারধারী ব্যাজিওর সেই শটটি গোলপোস্টের উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। ব্যাজিও হতাশায় মুখ লুকোলেন। সেইসাথে ফেবারিট তকমা পাওয়া ইতালি দলও। অন্যদিকে ব্রাজিল তখন বিশ্বকাপ জয়ের অানন্দে মাতোয়ারা।
সেই বিশ্বকাপে পাঁচ গোল করার সুবাদে সিলভার বল জিতেছিলেন ব্যাজিও। তবে সেই পেনাল্টি মিসের অাক্ষেপ কী ভুলতে পেরেছিলেন তিনি? নাকি সেই বেদনা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে জীবনভর? সেটিই ব্যাজিও-ই ভালো বলতে পারবেন। তবেই এই মিসটি যে ফুটবল বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে মূল্যবান পেনাল্টি মিস, সেটি অার বলবার অপেক্ষা রাখে না।