সময়টা ২০১০ সাল। বিশ্ব তখন কাঁপছে ফুটবল বিশ্বকাপ জ্বরে। প্রথমবারের মত বিশ্বকাপের আসর বসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেই বিশ্বকাপে মেসি, কাকা, ইনিয়েস্তাদের পাশাপাশি আরো একজনের উপর নিবদ্ধ ছিল পুরো বিশ্বের নজর। রাতারাতি বনে গিয়েছিল সে পুরো বিশ্বের তারকা। তার নাম ছিল পল, অক্টোপাস পল। জার্মানিতে এক অ্যাকুরিয়াম থেকে যে করেছিল বিশ্বকাপের নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী।
অক্টোপাস পলের জন্ম হয় ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের ওয়েইমাউথের সি লাইফ ইন্সটিটিউটে। জন্মের কিছুদিন পরে তাকে একই প্রতিষ্ঠানের জার্মানির ওবেরহাউসেন-এ স্থানান্তর করা হয়। সেখানে অবস্থানকালেই পল ২০০৮ সালের ইউরোর জার্মানির ম্যাচের ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া শুরু করে।
পলকে খাবার দেয়া হত দুইটি পাত্রে। পাত্র দুটির একটিতে থাকত জার্মানির পতাকা আর অপরটিতে থাকত তাদের প্রতিপক্ষের পতাকা। পল যে পাত্র থেকে খাবার খেত, সেই পাত্রে যে দেশের পতাকা থাকবে তাদেরকেই পল সম্ভাব্য বিজয়ী মনে করছে বলে মনে করা হত। এই পদ্ধতিতে জার্মানির ২০০৮ সালের ইউরো মিশনের ৬টি ম্যাচের মধ্যে পল ৪টির সঠিক অনুমান করতে পারে।
কিন্তু ২০১০ সালের বিশ্বকাপের সময়ে পলের এই প্রতিভা আরো বড় আকারে মানুষের সামনে চলে আসে। জার্মানির টেলিভিশন চ্যানেল NTV বিশ্বকাপের সময়ে পলের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে সরাসরি সম্প্রচার করা শুরু করে। বিশ্বকাপের জার্মানির যে সাতটি ম্যাচ খেলেছিলো তার প্রত্যেকটির বিজেতা কে হবে তা পল সঠিক অনুমান করেছিল। তখন বিদেশি মিডিয়াতেও অক্টোপাস পলের অভিনব জ্যোতিষি ক্ষমতা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। রাতারাতি অক্টোপাস পলের পরিচিতি পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পরে।
সেমিফাইনালে জার্মানির প্রতিপক্ষ ছিল স্পেন। সেই ম্যাচের আগে পল স্প্যানিশদের পক্ষে তার ভোট দিয়েছিল। ২০০৮ সালের ইউরোর সেমিফাইনালে যখন জার্মানি আর স্পেন মুখোমুখি হয়েছিল তখন পল জার্মানিকে বিজেতা বলে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তার সেই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল বলে প্রমানিত হয়েছিল। তাই এবারও যেন পলের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হয় তার জন্য জার্মান ভক্তরা প্রার্থনা করছিল। কিন্তু না। এবার অক্টোপাস পলের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যায়। সেমিফাইনালে স্পেন-এর কাছে হেরে যায় জার্মানি। শোকার্ত কিছু জার্মান ফ্যানরা এই হারের জন্য পলকে দায়ী করে ও তাকে মেরে ফেলার দাবি জানায়। সেইসময়ে স্পেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লুইস রড্রিগেজ অক্টোপাস পলকে স্পেন-এ পাঠিয়ে দেয়ার জন্য আহ্বান জানান এবং তাকে সেখানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হবে বলে ঘোষণাও দেন।
সেমিফাইনালের পর এবার আসল ফাইনাল ম্যাচ। স্পেনের প্রতিপক্ষ উরুগুয়েকে সেমিফাইনালে হারিয়ে আসা নেদারল্যান্ড। আবারো অক্টোপাস পলের ভবিষ্যদ্বাণীর অপেক্ষায় ছিল পুরো বিশ্ব। স্পেনকেই বেছে নিল পল ফাইনালের বিজেতা হিসেবে। পলের ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্যি প্রমাণ করে স্পেনই জিতে নিল বিশ্ব সেরার মুকুট।
অক্টোপাস পল সর্বমোট ১৪টি ম্যাচের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। যার মধ্যে ১২টিতে সে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। আর বিশ্বকাপের ৮টি ম্যাচের সবগুলোতে তার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গিয়েছিল।
২০১০ গালের ২৬শে অক্টোবর নিজের অ্যাকুরিয়ামে পলের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর সময়ে তার বয়স হয়েছিল ৩৩ মাস, যা একটি অক্টোপাসের জন্য স্বাভাবিক জীবনকাল।
পলের পরে আরও অনেক অক্টোপাস এবং অন্য প্রাণীদের দ্বারা বিশ্বকাপের ম্যাচের ফলাফল বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল, হাতি নেলি, ক্যাঙ্গারু ফ্লক্সি, উট শাহিন ইত্যাদি। কিন্তু তারা কেউই অক্টোপাস পলের মত সফল হতে পারেনি।
২০১০ সালে পলের মৃত্যুর পরে তার স্মরণে আইফোন “আস্ক দ্যা অক্টোপাস” নামের একটি অ্যাপ বের করে। ২০১৪ বিশ্বকাপের সময় গুগল তাদের ডুডলে অক্টোপাস পলকে দেখায়। সেখানে সে স্বর্গে বসে কোন দল জয়ী হবে তা বাছাই করতে ব্যস্ত। বিশ্বকাপ ফাইনালের আগেও গুগলের ডুডলে দেখা যায় ফাইনাল ম্যাচের উত্তেজনায় উল্লসিত অক্টোপাস পলকে। অক্টোপাস পল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও প্রতি বিশ্বকাপের আসরেই ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে তার নাম ও তার আশ্চর্য প্রতিভা সবসময় বেঁচে থাকবে।