হলিউড মুভি দেখে আমেরিকান জেলখানাগুলো নিয়ে আমাদের অনেকেরই মনে কিছু না কিছু ধারণা জন্মেছে। আমরা জানি যে জেলখানাগুলো বানানো হয় কুখ্যাত অপরাধীদের বা অপরাধী চক্রকে শায়েস্তা করার জন্য। অপরাধীদের এমন একটি পরিবেশের মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয় যাতে তারা বাইরের জগতের সাথে কোন সম্পর্ক না রাখতে পারে। কিন্তু আমেরিকার জেল প্রশাসন এই ব্যাপারটিতে একপ্রকার ব্যর্থই বলা চলে। অপরাধীরা আমেরিকান জেলে আরও সংগঠিত হয়। জেলের ভেতর থেকেই তারা চালাতে থাকে তাদের দুষ্কর্ম। তাদের মধ্যে অনেকেই কারারক্ষীদের ঘুষ দিয়ে বাইরের জগতেও নিজেদের অপরাধকর্ম চালিয়ে যায় দিনের পর দিন। নিজেদের গ্যাংকে বানিয়ে ফেলে আরো শক্তিশালী। তাদেরকে সংশোধন করা দূরের কথা, জেলের ভেতরের বিভিন্ন গ্যাংদের মধ্যে লেগে থাকা কলহ সামলাতে সামলাতেই কর্তৃপক্ষের ঘাম ছুটে যায়। এই কলহগুলো অনেকসময়ই প্রাণঘাতী রূপ নেয়।
আমেরিকান জেলখানায় কয়েদির সংখ্যা পুরো বিশ্বে সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে ৫ হাজার জেলে আটকে আছে ২২ লাখ কয়েদী, যা আমেরিকার একটি রাজ্য নিউ মেক্সিকোর জনসংখ্যার চাইতেও বেশি। আর এদের পিছনে আমেরিকান সরকারের প্রতিবছর ব্যয় হয় ৭০ বিলিয়ন বা ৭ হাজার কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের বাজেটের চাইতেও বিশ বিলিয়ন ডলার বেশি। প্রায় ২৭ লক্ষ আমেরিকান শিশুর বাবা বা মা জেলে বন্দী। সবথেকে বেশি কয়েদী সংখ্যার তালিকায় আমেরিকার পরেই রয়েছে চীন এবং রাশিয়া।
সেখানকার জেলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে মাদক। মোট কয়েদীর অর্ধেকই কোন না কোনভাবে মাদক জড়িত অপরাধে দন্ডিত হয়ে জেলে আটক হয়েছে। গত ২০ বছরে জেলের কয়েদীর সংখ্যা ৩০০% বেড়েছে শুধুমাত্র সহিংসতা এবং মাদকের কারণে। এই বিশাল কয়েদী সংখ্যাকে সামাল দেয়ার জন্য নতুন জেল তৈরি হচ্ছে আমেরিকান সরকারকে। শুনলে অবাক হবেন আমেরিকায় কলেজের চাইতে জেলের সংখ্যা বেশি।
এই জেলগুলোর যারা দেখাশোনা করেন তাদেরকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকতে হয়। কারণ কয়েদীরা দাঙ্গা ঘটিয়ে দেয়ার জন্য সবসময় উৎ পেতে বসে থাকে। আর এদের নিয়ন্ত্রণ করাও এতটা সহজ নয়। জেলে নিজেদের দল বানিয়ে আর প্রশাসনকে ঘুষ দিয়ে বিভিন্ন ধরণের সুযোগ সুবিধা আদায় করে নেয়া তাদের কাছে ডাল-ভাত। কোন কারারক্ষী যদি তাদের সাথে অতিরিক্ত খারাপ আচরণ করে তবে তাকে শাস্তি দিতে কয়েদীরা পিছপা হয় না। ব্রাশ, শক্ত প্লাস্টিক, কাঁচ, লোহার শিক দিয়ে ছুরি বানায় বন্দীরা অ প্রয়োজনের সময় সেগুলো ব্যবহার করতে পিছপা হয় না।
আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যের এক জেলখানায় একজন অফিসার বন্দীদের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করতেন। তাই বন্দীরা এক ফন্দী আঁটে অফিসারকে শায়েস্তা করার জন্য। এক দুপুরবেলা দুই বন্দীর মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায়। ঝগড়া থামানোর জন্য ঐ অফিসার কন্ট্রোল রুম থেকে বের হন। বন্দীদের ওই সেলে যাওয়া মাত্রই তার উপর অতর্কিত হামলা চালায় আরো দুই বন্দী। কোন সাহায্য আসার আগে মোট ৬০ বার তাকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। অফিসারকে সহকর্মীরা এসে তাকে উদ্ধার করে। সেবার ভাগ্যের জোড়ে প্রাণে বেঁচে যান অফিসার। কিন্তু সব অফিসারের ভাগ্য এত সুপ্রসন্ন নয়।
বন্দীদের এধরণের কার্যকলাপের কারণে আমেরিকায় জেলরক্ষীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় যা ৩২০০ জন কম। খুব সহজে কেউ এই বন্দীদের কাছে যেতে চায় না। বন্দীদের নোংরা ভাষা, আচরণ, হুমকি সহ্য করা নিশ্চয়ই এত সহজ নয়। এই বন্দীরা ভয়ংকরভাবে সংঘবদ্ধ থাকে। যদি কেউ খুনের মামলায় জেলখানায় আসে তবে তাকে দিয়ে আরো খুনের কাজ করানো হয়। এক বন্দী যদি অন্য আরেকজন বন্দীকে খুন করে কোন প্রমাণ যদি না রাখে তবে তাকে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ দিনের সাজা ভোগ করতে হয় অন্য সেলে। তাই কেউ অন্য বন্দীর নামে সাক্ষ্য দেওয়ার সাহস করে না। এদেরকের আলাদা করা সহজ কাজ নয়। বন্দীদের শায়েস্তা করতে প্রায়ই অভিযান চালানো হয় কিন্তু তা খুব একটা কাজে দেয় না। নিত্য নতুন অভিনব উপায়ে তারা নিজেদের অপরাধকর্ম চালিয়ে যায়। প্রশাসন তাদের কাছে একরকম বলতে গেলে অসহায়।
জেলের এইসব কুখ্যাত দলের প্রথম সারির কয়েকটির নাম হচ্ছে- Netas, 415 Kumi, Dead man inc, Nazi low riders, Texas syndicate, MS13, Black Guerrilla family, Mexican mafia, La nuestra, Aryan brotherhood.
এর মধ্যে সবচাইতে মারাত্মক Aryan brotherhood। তারা AB নামেও পরিচিত। তারা জেলের মাঝে জুয়া পরিচালনায় দক্ষ। তাদের দর্শন – “blood in blood out”. তাদের সংখ্যা আমেরিকার জেলগুলোর মোট কয়েদীর ১% এবং জেলে ঘটিত খুনের ১৮% তারা ঘটিয়ে থাকে।
আমেরিকার প্রতি ১ লাখের মধ্যে ৭২৪ জন লোক বর্তমানে জেলের বাসিন্দা হয়ে দিন কাটাচ্ছে। এই বিশাল জনসংখ্যার চাপ কমাতে বাধ্য হয়ে আইন পরিবর্তন করেছে আমেরিকার সরকার। প্রথমবার মাদক সংক্রান্ত মামলায় ধরা পড়লে সাজা কমিয়ে এখন সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদন্ড করা হয়েছে। মূলত জেলের বন্দীর চাপ কমানোর জন্য এই উপায়ের দ্বারস্থ হয়েছে প্রশাসন। আমেরিকার জেল ব্যবস্থার এই বেহাল দশা তাদের প্রশাসনিক ব্যর্থতার মধ্যে অন্যতম।