হুমায়ুন ফরিদী। নব্বইর দশকের প্রজন্মকে নস্টালজিয়ায় ভোগাতে এই দুটো শব্দই হয়তো যথেষ্ট। আসলেই তো! না হলে সংশপ্তক নাটকের ‘কান কাটা রমজান’ কিংবা একাত্তরের যীশু চলচ্চিত্রের “কেয়ারটেকার ডেসমন্ড” এর কথা কেউ কি ভুলতে পারে? এরকম নানা ভিন্নধর্মী চরিত্র নিয়ে ক্যামেরার সামনে হাজির হয়েছেন এই সব্যসাচী প্রতিভা। কখনো হাসিয়েছেন, কখনো কাঁদিয়েছেন আবার কখনো করেছেন অন্য আবেশতায় মুগ্ধ। এভাবেই এই ক্যারিশমাটিক মানুষটি নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তীর কাতারে।
হুমায়ুন ফরিদীর জন্ম ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালে। দিনটা ২৯ মে, স্থান ঢাকার নারিন্দা। বাবা এ টি এম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। ফরীদিরা চার ভাই-বোন। তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। মজার ব্যাপার হল, এই অভিনেতার আসল নাম হল হুমায়ুন কামরুল ইসলাম। তার নামের সাথে তিনি ‘ফরিদী’ যোগ করেন মায়ের নাম থেকে।
নিজ গ্রাম কালীগঞ্জেই প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। এরপর ১৯৬৫ সালে পিতার চাকরীর সুবাদে মাদারীপুরের ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে সেখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি। এর দুবছর পর চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাস করেন।
মিডিয়া জগতে হুমায়ুন ফরিদীর আগমন মঞ্চ নাটকের হাত ধরে। প্রথম মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন মাদারীপুরেই। নাটকের নাম ছিল ‘মুখোশ যখন খুলবে’।
এই গুণী অভিনেতার নাট্যজীবনের প্রথম গুরু ছিলেন নাট্যকার বাশার মাহমুদ। বাশার মাহমুদের শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী নামের একটি সংগঠনের হয়ে ফরীদি ‘টাকা আনা পাই’, ‘দায়ী কে’, ‘সমাপ্তি’, ‘অবিচার’, ‘ত্রিরত্ন’সহ ছয়টি মঞ্চ নাটকে অংশ নেন।
হুমায়ুন ফরিদীর শিক্ষাজীবন খানিকটা হলেও ব্যাহত হয় সেসময়কার দেশের রাজনৈতিক অবস্থার পট পরিবর্তনের কারণে। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নে স্নাতক শ্রেনীতে ভর্তি হলেও মুক্তিযুদ্ধের কারণে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসতে হয় পিতার কর্মস্থল চাঁদপুরে। স্বাধীনতার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হন। স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন।
ফরিদীর ক্যারিয়ারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন এবং নাট্যোৎসবের প্রধান আয়োজক হিসেবে কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনে যোগ দিয়ে ফরীদির প্রথম নাটকটির নাম ছিলো শকুন্তলা, যাতে তিনি অভিনয় করেছিলেন তক্ষক চরিত্রে।
এদেশে যখন নাট্য মঞ্চের সংকট, তখন হুমায়ুন ফরিদীর আবির্ভাব ঘটে অনেকটা ধুমকেতুর মতোই। বেশ কিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর অভিনীত মঞ্চ নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শকুন্তলা, কির্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি এবং ফণীমনসা, ধূর্ত উইঁ। এছাড়াও মঞ্চনাটককে এদেশের গণমানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন নাটক কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও গ্রাম থিয়েটার এর অন্যতম।
টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরিদীর অভিষেক ঘটে আতিকুল হক চৌধুরীর পরিচালনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নাটকের মধ্য দিয়ে। এরপর নীল নক্সার সন্ধানে (১৯৮২), দূরবীন দিয়ে দেখুন (১৯৮২), ভাঙ্গনের শব্দ শুনি (১৯৮৩), বকুলপুর কত দূর (১৯৮৫), দু’ভুবনের দুই বাসিন্দা, একটি লাল শাড়ি, মহূয়ার মন (১৯৮৬), সাত আসমানের সিঁড়ি (১৯৮৬), সংসপ্তক (১৯৮৭-৮৮), পথের সময় (১৯৮৯), শীতের পাখি (১৯৯১), কোথাও কেউ নেই (১৯৯০), সমুদ্রের গাঙচিল (১৯৯৩), তিনি একজন (২০০৫), চন্দ্রগ্রস্ত (২০০৬), কাছের মানুষ (২০০৬), ভবের হাট (২০০৭), শৃংখল (২০১০), প্রিয়জন নিবাস (২০১১), ইত্যাদি নাটকে সফল অভিনয় করেন।
বড় পর্দায় প্রথম অভিনয় করেন ১৯৮৫ সালে শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’ চলচ্চিত্রে। প্রথম প্রথম নায়কের চরিত্রে অভিনয় করলেও কালক্রমে জনপ্রিয়তা পান খল চরিত্রে। ফরিদী অভিনীত প্রথম বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র ‘দিনমজুর’ এর পরিচালনায় ছিলেন শহীদুল ইসলাম খোকন। বীর পুরুষ, দুর্জয়, শাসন, মায়ের অধিকার, ভণ্ড, – ইত্যাদি তাঁর আলোচিত বানিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর্ট ফিল্মে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হুলিয়া, ব্যাচেলর, আহা, মাতৃত্ব, বহুব্রীহী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া ও একাত্তরের যিশু। মাতৃত্ব চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
টেলিভিশনের পর্দায় খল ও কূট চরিত্র করে দিনের পর দিন হল মাতিয়ে রাখা এই মানুষটি আক্ষরিক অর্থেই বাস্তব জীবনে ছিলেন একজন নায়ক। একাত্তরে তিনি দেশমাতৃকার জন্য অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। ব্যাক্তিগত জীবনে নিরহংকারী মানুষটি কখনো সেসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। সনদেরও প্রয়োজন বোধ করেননি কখনো।
হুমায়ুন ফরিদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসেবে অভিনয় বিষয়ে কিছুদিন পাঠ দান করেন। ব্যাক্তিজীবনে সদালাপী ও মিষ্টভাষী মানুষটি সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন আজ থেকে আট বছর পূর্বে। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
হুমায়ুন ফরিদীর জীবন ও কর্মের মূল্যায়ন করতে এসে তার উত্থান-পতন চলচ্চিত্রের একটি সংলাপের কথা উল্লেখ করতেই হয়,
আমারে যারা আইজ চিনো নাই কাইল চিনবা, কাইল না চিনলে পরশু চিনবা। চিনতেই হইবো – নাম আমার রমজান আলী।
আসলেও তাই। হুমায়ুন ফরীদিকে দেরিতে হলেও চিনেছি আমরা। উপলব্ধি করতে পেরেছি তার গুরুত্ব। তাইতো মৃত্যুর এতোদিন পর এসে তাকে ভূষিত করা হয়েছে অমর একুশে পদকে। অভিমানী মানুষটি চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে, তবে রেখে গেছেন তার সৃষ্টিকর্মগুলো। হয়তো সেকারণেই তার মৃত্যুতে সৃষ্ট অপার শুন্যতাটা অনুভব করতে একটু বেগ পেতে হয় বৈকি! কিন্তু যখন সেগুলো চোখের সামনে এসে পড়ে, মনে কেবল একটা চিন্তাই উকি দেয়।
মানুষকে চিনতে বড্ড দেরী হয়ে গেল না!