নিকোলাইঃ কখনো কি শুনেছেন সেনা কমান্ডোরা মাফিয়া টিম তৈরি করতে পারে? হ্যা পারে। মেক্সিকোতে মাদক ব্যবসায় যে কেউ, যেকোন সময় মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যায়। আর সে সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিল মেক্সিকান সেনা কমান্ডোরা। যা আজ থেকে ২০ বছর আগের ঘটনা যাতে উত্থান হয় লস জেটাস মাফিয়ার। মেক্সিকান বর্ডারে বিশেষ করে জুয়ারেজ ভ্যালিতে তারা জেটা ক্লান নামে পরিচিত।
গাল্ফ কার্টেলের নেতা জুলিয়েন নিজেকে অন্য মাফিয়ার হাত থেকে বাঁচাতে এক সাবেক সেনা সদস্যকে নিজের দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি আরো ৩০ জন সেনা সদস্যকে মার্সেনারি হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর সেই সৈন্যরা হঠাৎ করেই নিজেরা একটা দল খুলে বসে, নাম দেয় লস জেটাস। শুধু তাই নয়, নিজেদের ক্ষমতা বোঝানোর জন্য মেক্সিকোর রাজপথ এবং অলিগলিতে ব্যাপক হারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দলটি।
১৯৯০ সালে আমেরিকান সেভেন্থ স্পেশাল ফোর্স এর মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখানে কমান্ডো হওয়ার জন্য যাবতীয় সকল সুযোগ ও ট্রেনিং তারা পায়। এই ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল নিজ দেশকে মাদকের কালো থাবা থেকে রক্ষা করা। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! তারা নিজেরাই এখন মেক্সিকান ড্রাগ লর্ডদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সেনাবাহিনীর অন্যতম বড় শত্রু। ২০১১ সালে মেক্সিকোর অর্ধেক রাজ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় লস জেটাস এবং তারা সিনোলিয়া ড্রাগ কার্টেলকে পিছনে ফেলে দেয়। লস জেটাস যে শুধুমাত্র মেক্সিকোতেই কার্যক্রম চালায় তা নয়। পাশের দেশ আমেরিকাতেও তাদের প্রভাব রয়েছে। ২০১০ সাল থেকে আমেরিকাতে নিজেদের লোকবল বাড়াচ্ছে লস জেটাস। এফবিআই, সিআইএ বহু চেষ্টা করেও এদেরকে সরাতে পারছে না কারণ খোদ আমেরিকান মাফিয়ারা লস জেটাসের হয়ে কাজ করতে আগ্রহী। নিউমেক্সিকো, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, লাসভেগাস, এরিজোনাতে লস জেটাসের স্থানীয় মার্সেনারি এবং ডিলাররা সক্রিয়।
নিজ দেশের রাজনীতিবিদদের অনেককেই পকেট গরম রাখতে সাহায্য করে লস জেটাস।আর এটাই তাদের ক্ষমতার অন্যতম বড় উৎস। ২০১১ সালে মেক্সিকান টামাউলিপাস শহরের গভর্নর ইয়ারিংটন মাফিয়াদের সাথে যোগাযোগ রাখার কারণে গ্রেফতার হন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি লস জেটাস এবং গাল্ফ কার্টেলকে নিজ এলাকায় কার্যক্রম এর অনুমতি দিয়েছেন। আরো বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের নামে এ অভিযোগ রয়েছে। এসব রাজনীতিবিদের কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা প্রশাসনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় আর দিন দিন শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করে।
মেথাফিটামিন শব্দটা শুনলেই বিখ্যাত টিভি সিরিজ BREAKING BAD এর কথা মনে পড়তে পারে অনেকেরই। এই মেথাফিটামিন, এক্সট্যাসি ট্যাবলেট লস জেটাসের অন্যতম মাদকপণ্য। সাথে রয়েছে মারিজুয়ানা। লস জেটাস বর্তমানে ৪৭টি দেশে তাদের মাদক উৎপাদনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যার মধ্যে লাতিন আমেরিকান দেশগুলো অন্যতম। শুধু যে মাদক ব্যবসাই তাদের আয়ের অন্যতম পথ, তা কিন্তু নয়। মুক্তিপণ, নারী পাচার, মদ, জুয়া – এগুলোও তাদের আয়ের অন্যতম উৎস। প্রতি বছর এগুলো থেকে তারা বিলিয়ন ডলার অর্থ আয় করে। ২০১০ সালে তারা ৭২ জন অভিবাসীকে হত্যা করে শুধুমাত্র মুক্তিপণ না পাওয়ার কারণে। তাদের অন্যতম নেতা মিগুয়েল একাই প্রত্যক্ষভাবে ২০০০ লোকের হত্যার সাথে জড়িত। এম এস থার্টিন এর সাথে পাল্লা দিয়ে তারা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
লস জেটাস এর এতো ক্ষমতাবান হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় তাদের নিজস্ব যোগাযোগ ব্যবস্থাকে। যোগাযোগ রাখার জন্য তারা কারো ওপর নির্ভরশীল নয়। বেশ কয়েক বছর আগে তারা ৩০ জনই ইঞ্জিনিয়ারকে অপহরণ করেছিলো শুধুমাত্র নিজেদের কমিউনিকেশন সিস্টেম তৈরি করার জন্য। তাদের বেতার সংযোগ মূলত এই ইঞ্জিনিয়াররাই দেখাশোনা করতে বাধ্য হন। বহু চেষ্টা করেও এ ব্যবস্থা নষ্ট করা যায়নি। ধারণা করা হয় ড্রাগ কার্টেলদের মধ্যে সবচাইতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লস জেটাস। তাদের ধারেকাছেও অন্য কোন গ্রুপ নেই।
নিজেদের দুর্ধর্ষ প্রমাণ করতে এমন কাজ নেই যা তারা বাদ রেখেছে। অন্য কোন গ্রুপের সাথে কোনরকম সমঝোতা করে তারা চলে না। যে গ্রুপই তাদের পথের বাধা হোক না কেন, লস জেটাস তাদের শেষ করেই ছাড়বে। নিজেদের গ্রুপের কেউ ধরা পড়লে তাকে ছাড়িয়ে আনা তাদের কাছে ডাল ভাত। ৫ বছর আগে তারা তাদের রিং লিডারের লাশ মেক্সিকো সরকারের কাছ থেকে দাবি করে। কিন্তু সরকার তা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানালে লস জেটাস নিজেদের দাপট দেখানোর উছিলা পেয়ে যায়। ৭০০ মেক্সিকান সৈন্যকে পরাস্ত করে নিজেদের নেতার লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যায় সংগঠনটি। জেলে নিজেদের কোন লোক নিজ দলের বিপক্ষে সাক্ষী হতে চাইলে তাকেও বিনা নোটিশে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য রাখে মাফিয়া সংগঠনটি। আমেরিকান জেলেও নিজেদের সদস্য সংগ্রহ করে চলেছে দলটি। আর এভাবেই গত বিশ বছর ধরে নিজেদের আধিপত্য ধরে রেখেছে এই মাফিয়া দল লস জেটাস।