বইয়ের নাম: বিক্ষোভের দিনগুলিতে প্রেম।
লেখক: আনিসুল হক।
বিষয়বস্তু : মেজর জিয়া হত্যার পর স্বৈরশাসক হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসন, সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন। অাশির দশকে বুয়েটে অস্থিতিশীল অবস্থা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমজনতার বিক্ষোভ।
প্লট : বুয়েট ক্যাম্পাস, টিএসসি।
ঘটনার প্রেক্ষাপট ও সারসংক্ষেপ :
মেজর জেনারেল জিয়া হত্যার পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার গদিতে বসলেন। কিন্তু ওপর থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকলেন এরশাদ। তখন দেশে “সেনাপ্রধানের কথাই শেষ কথা” এই বাণীটি ব্যবহার করে সংবিধানের পরোয়া না করে ক্ষমতা দখল করে নিলেন তিনি। এরপর তার দুর্নীতি, নারী কেলেংকারির মত ঘটনাগুলো দেশের মানুষের কাছে প্রকাশ পেতে থাকলো। এমন এক টালমাটাল পরিস্থিতি থেকে শুরু হয় উপন্যাসটি।
৮০ এর দশকের শুরুতে দেশের তিনটি জেলা থেকে অাগত তিনজন যুবক ভর্তি হয় বুয়েটে। তারা হলো শওকত, আবীর ও মাকসুদার। ঢাকায় আসার পর নানা সমস্যায় ভুগতে শুরু করে তারা। বুয়েটে প্রথম বর্ষে কয়েক সপ্তাহ ক্লাস হবার পরেই ক্লাস বর্জনের ঘোষনা অাসে। সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থার প্রণয়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ এ বর্জন।
একপর্যায়ে দেশে কারফিউ জারি হয়। বেশ কিছু ছাত্র মারা যায়, একজন চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটির কথা বলতে গেলে বলতে হয় কোমলমতি শিশু শিল্পী দীপালী দাশের মৃত্যু। শিশু একাডেমির একটি গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে প্রাণ হারায় শিশুটি।
ধীরে ধীরে আন্দোলন সাধারন জনগনের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে অনেক বুয়েটের ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। এই আন্দোলন চুড়ান্ত রুপ ধারণ করে ৯০ সালে। “স্বৈরশাসন নিপাত যাক, গনতন্ত্র মুক্তি পাক” এমন স্লোগান বুকে ধারণ করে রাজপথে নামেন নূর হোসেন। সেনাবাহিনীর গুলিতে তার শরীর ঝাঝরা হয়ে যায়। ডা.মিলন তার দুই বছরের শিশু সন্তানকে চকলেট কিনে দেয়ার কথা বলে বাইরে যান । কিন্ত অার ফেরেন না। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাসের কাহিনী।
ঘটনার উল্লেখযোগ্য চরিত্র ও তাদের কিছু বর্ননা:
১.শওকত: রংপুরের একটি অজপাড়া গা থেকে অাগত। বাবা সামান্য স্কুল শিক্ষক। পরিবারের সবার ছোট এবং একমাত্র পুত্র সন্তান। অনেক আশা নিয়ে বুয়েটে পড়তে আসে সে। আর টিউশনির টাকা দিয়ে মাস চালায় যথেষ্ট সংগ্রামের সাথে।
২. আবীর: আর্কিটেকচারের অাবীর যথেষ্ট মেধাবী, তবে পড়াশুনার নাম গন্ধ নেই। এককথায় প্লেবয় যাকে বলে আরকি! দৈনিক বাংলায় লেখালেখির সুবাদে শানু নামের এক নারীর সাথে তার পরিচয় হয়। পত্র আদান প্রদানের বিষয়টাও যথেষ্ট চমকপ্রদ। এখনকার ফেইক আইডির মতো অনেক উড়ো চিঠি তখন লেখা হতো (ছেলেরা মেয়ে পরিচয় দিয়ে চিঠি লিখতো)। তো শানুর সাথে অনেক থেকেই পরিচয়। স্বামী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, সংসারে ২ সন্তান। অবসর সময়গুলো যুবক ছেলেদের সাথে কাটায়। এভাবেই অাবীরের সাথে শানুর পরকীয়ার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন জানা যায় শানুর গর্ভে আবীরের বাচ্চা। আবীর খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। এমনকি তার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। শেষমেশ আবীরের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।
৩. মাকসুদার: লোকটি সিরাজগঞ্জের, একটু পাগলাটে কিসিমের। নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার শব্দটি রাখতে চান, কিন্তু তার স্বপ্ন বড় কবি হবেন। তার কাব্য চর্চার শুরু একই বিভাগের সহপাঠী মৌটুসির প্রতি ভালোবাসা থেকে। ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে তার কাব্য চর্চার কথা শামসুর রহমান পর্যন্ত পৌছে যায়। আজ তিনি বেশ নামকরা চিরকুমার কবি।
৪. ডা.মিলন: ঢামেক এর ডাক্তার ছিলেন তিনি। এক কন্যা, বউ কবিতা, মাকে নিয়ে ভালোই দিন পার করছিলেন। কাব্য মনা ছিলেন তিনি। একজন বিখ্যাত কবির (কবির নাম মনে পড়ছে না) “জেলখানায় বন্দি” কবিতাটি তিনি সবসময় স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে শোনাতেন। ৯০ এর ফেব্রুয়ারিতেই সামরিক সরকার পতনের দিনে দোকানে যাওয়ার কথা বলে আর ফেরেন নি।
৫. হাবীব: তিনি জাসদের ছাত্র নেতা ছিলেন। আন্দোলন এর আগে সবাইকে প্রস্তুত করতেন। তিনি সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেননি।
লেখকের সার্থকতা :
অাশির দশকের সমাজ ব্যবস্থার একটা বাস্তব চিত্র লেখক তার লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন। এরশাদের শাসন এমন ভয়াবহ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যেন মনে হয়েছে বাংলাদেশের মতো স্বাধীন রাষ্ট্রে ফিরে এসেছে ইয়াহিয়া খানের প্রেতাত্মা। বুয়েটের হলের থমথমে পরিস্থিতিকে তিনি তুলনা করেছেন একাত্তরের কোনো এক ফায়ারিং স্কোয়াড এর সাথে। কাকতালীয়ভাবে বুয়েটের আন্দোলন আর ফ্রেবুয়ারীর ভাষা আন্দোলন একই মাসে হয়েছিলো। তাই তিনি এমনভাবে বর্ননা করেছেন যেন মনে হয় বায়ান্ন’র ২১ শে ফেব্রুয়ারির আগের রাত ফিরে এসেছে বাংলার বুকে।
তখনকার দিনে যে মেয়েদের নাম দিয়ে যেসকল উড়ো চিঠি আসতো তাকে এখনকার ফেইক আইডির সাথে চমৎকার সামঞ্জস্যপূর্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন লেখক। লেখক শওকতের মধ্যে বাবা হারানোর আবেগ আর সেলিনা পারভিনের মধ্যে সন্তান হারানোর আবেগ এমনভাবে তুলে ধরেছেন যে কেউ ওই বইটি পড়া অবস্থাতেই কেঁদে দিতে বাধ্য।
সর্বোপরি বলা যায়, শক্তিমান লেখক অানিসুল হকের লেখা বিক্ষোভের দিনগুলোতে প্রেম বইটি একটি সুখপাঠ্য বই। পাঠকদের নির্দ্বিধায় বইটি পড়ার অনুরোধ করা গেল।