লীলা নাগ: বাঙ্গালি নারী জাগরণের পথিকৃৎ

সবেমাত্র বিশ শতকের সূত্রপাত হয়েছে তখন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীশিক্ষা, নারীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ তখনও প্রায় নৈব নৈব চ। কিছু নারী অবশ্য দমে যাননি; সমাজের মুখাপেক্ষী হয়ে না থেকে নারীর শিক্ষা, নারীর রাজনীতি, নারীর আন্দোলন সকল ক্ষেত্রেই সমান অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে একজন বিখ্যাত নারী লীলাবতী নাগ। লীলা নাগ এর পরিচয় দিতে গেলেই আমরা এক ডাকে তাঁকে স্মরণ করতে পারি, কারণ তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী। তাঁরই অনুপ্রেরণাতে পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটে। তিনি কেবল শিক্ষাক্ষেত্রেই সচেতন ছিলেন না, উপরন্তু তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর একনিষ্ঠ সহকারী। সকল আন্দোলনের ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনন্য পথিকৃৎ। তাই আজও বিপুল শ্রদ্ধার সঙ্গে এই মহীয়সী নারীটিকে স্মরণ করা হয়।

জন্মকথাঃ

লীলা নাগের জন্মস্থল

লীলা নাগ ১৯০০ সালের ২১শে অক্টোবর আসাম প্রদেশের গোয়ালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রায়বাহাদুর গিরীশচন্দ্র রায় ছিলেন আসাম সরকারের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। চাকরির সুবাদেই তিনি আসামেই থাকতেন এবং সেখানেই লীলার জন্ম হয়। মাতা ছিলেন কুঞ্জলতা নাগ ছিলেন একজন আদর্শ গৃহিনী। তার পিতৃ পরিবার ছিল সিলেটের মৌলভীবাজারের সংস্কৃতিমনা, শিক্ষিত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার। এই পরিবারের ছায়াতলে থেকেই তিনি শিক্ষা, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রে সমান অবদান রাখতে পেরেছেন।

শিক্ষাজীবন:

লীলা নাগ (রায়) এর পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় ১৯০৫ সালের দেওঘরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর তিনি কলকাতার ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর ঢাকাতে আসেন। ঢাকায় আসার পর ১৯১১ সালে ইডেন হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং এখান থেকেই ১৯১৭ সালে পনের টাকা বৃত্তি নিয়ে তিনি সাফল্যের সাথে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৭ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন। কলেজে ভর্তির পরেই লীলা নাগ পড়াশোনা ছাড়াও গান, সেতার বাজানো, ছবি আঁকা সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কৃতিত্বের ছাপ রাখেন। কলেজে পড়াকালীন সময়ে তিনিই প্রথম “বড়লাট”কে নতজানু করে অভিবাদন জানানোর প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করেন।
১৯২১ সালে তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথমস্থান অধিকার করে বেথুন কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন এবং প্রথমস্থান অধিকার করায় তাকে “পদ্মাবতী” পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সেই বছরেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার প্রচলন ছিল না। তিনি তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ পিজে হার্টজ কাছে আবেদন জানান। ডঃ পিজে হার্টজ তাঁর মেধার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে প্রথম ছাত্রী হিসেবে মাস্টার্স শ্রেণিতে ইংরেজি বিষয়ে ভর্তির সুযোগ দেন। লীলা নাগ ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।

সমাজকর্মঃ

“মেয়েদের উপার্জনশীল হতে হবে, নইলে তারা পুরুষের মতো মর্যাদাশীল হতে পারবে না”- এই চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন লীলা নাগ। তাই সমাজে মেয়েদের শিক্ষিত করার পাশাপাশি উপার্জনশীল করার লক্ষ্যে মেয়েদের বিভিন্ন হাতের কাজ বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এম.এ পরীক্ষা পাশের পর বাংলার নারী সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন অভিশপ্ত জীবনে জ্ঞানের আলো উন্মুক্ত করতে ১২ জন নারী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন “দীপালি সংঘ” এর।

বাংলায় নারীদের শিক্ষা বিস্তারে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুল এবং শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়। এগুলো তৎকালীন নারী শিক্ষা প্রসারে ব্যাপক প্রভাব রেখেছিল। ভারত ভাগের পর লীলা কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে আরো কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ছাত্রীদের সুবিধার জন্য তিনি কলকাতায় একটি মহিলা হোস্টেলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সাধারণ জনতার পর্যায়ে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য তিনি ‘গণশিক্ষা পরিষদ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিলেন। নারীদের আত্মবিশ্বাসী ও সাহসীভাবে তৈরি করার জন্য তিনি মার্শাল পদ্ধতিতে আত্মরক্ষামূলক ফান্ড “আত্মরক্ষা ফান্ড” তৈরি করেছিলেন। নারীদের প্রতি অন্যায় অত্যাচার রোধকল্পে এবং নারীদের শিক্ষিত করার লক্ষ্যেই তিনি এসকল প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন।

সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন লীলা নাগ সম্পর্কে তার স্মৃতিকথা নামক প্রবন্ধে লেখেন,

“এঁর মত সমাজসেবিকা ও মমতাময়ী নারী আর দেখি নাই। এঁর থিওরি হল, নারীদেরকেও উপার্জনশীলা হইতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবিলক্লথ প্রভৃতির উপর নকশা এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব বিক্রি করে তিনি মেয়েদের উপার্জনের পথ উন্মুক্ত করে দেন।”

এভাবেই সমাজে শিক্ষাক্ষেত্রে, নারীর মনোবল বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তিনি অবদান রাখেন।

রাজনীতিতে অংশগ্রহণঃ

লীলা নাগ সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯২৫ সালে “শ্রীসঙ্গ” নামে একটি একটি বিপ্লবী দলের সদস্য হন। লবণ সত্যাগ্রহের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে ঢাকায় মহিলা সত্যাগ্রহ নামে একটি প্রতিষ্ঠা গড়ে তোলেন। শ্রীসঙ্গের প্রধান অনিল রায় গ্রেফতার হওয়ার পর তার উপর শ্রীসঙ্গের দায়িত্ব ন্যাস্ত হয়। ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেস ও বাংলার বিপ্লবী দলগুলি সুভাষচন্দ্র বোসের সাথে একত্রিত হয়। শ্রীসঙ্গের সদস্যরা কলকাতায় সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনার জন্য অস্ত্র ও বোমা তৈরি করেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠণের জন্য চট্টগ্রামের ইন্দুমতি সিংহকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে দেন। লীলা নাগের কাছ থেকেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জীবনের পাঠ নিয়েছিলেন।

১৯৩১ সালে এপ্রিলে তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং আলীপুরের জেলা জজ গার্লিক ও কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সর নিহত হওয়ায় দুজন তরুণীর দিকে সন্দেহের তীর উঠে। ফলে প্রথম নারী রাজবন্দী হিসেবে লীলা নাগ কে আটক করা হয়। তিনি গ্রেফতারের পর তার অনেক নারী সহকর্মীও গ্রেফতার ও বন্দী হন। পরবর্তী সময়ে তিনি মুক্তি পান। ১৯৩৬ সালে তিনি কংগ্রেসের প্রার্থীরূপে সাধারণ নির্বাচনে মনোনয়ন পান। কিন্তু ভোটার তালিকায় নাম না থাকায় তিনি প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারেননি। তিনি মহিলা সমাজে একজন অনন্য মুখপাত্র ছিল। ‘জয়শ্রী’ নামে একটি পত্রিকাও তিনি বের করেছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের পরামর্শে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন।

১৯৩৯ সালের ১৩ই মে তিনি ঢাকায় অনিল রায়ের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর তাঁর নামের পর রায় পদবী যুক্ত হয়। বিয়ের পর লীলা ও তার স্বামী পূর্ববঙ্গে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের কোপানলে তাঁরা ১৯৪৭ সালে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ১৯৫২ সালের লীলা রায়ের স্বামী অনিল রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিয়ের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় স্বামীকে হারিয়ে তিনি শারিরীক ও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েন।

মৃত্যুঃ

১৯৬৬ সালে তিনি শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সকালবেলা জ্জানহীন অবস্থায় পিজি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ২৩ দিন পর জ্ঞান ফিরে এলেও ডানপাশ সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। ৪ আগস্ট সেরিব্রাল আক্রমণে তিনি কোমায় চলে যান। প্রায় আড়াই বছর কোমায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় থাকার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বাঙালি নারীদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে লীলা নাগের ভূমিকা অপরিসীম। তার দেখানো পথেই নারীরা আজ নিজেদের স্বাবলম্ভী হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। তার আজও তিনি বাংলার নারী সমাজের কাছে পরম পূজনীয় একজন ব্যক্তি। এভাবেই যুগ যুগ ধরে তিনি বেঁচে থাকবেন শত মানুষের হৃদয়ে।

Post Author: Sushmita Chakraborty

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *