সোশ্যাল মিডিয়া: অাসলেই কি সোশ্যালাইজেশনের হাতিয়ার?

বর্তমানের নেটিজেনরা দিনের বড় একটি অংশ ফেসবুক, টুইটার তথা ওয়েব দুনিয়ার একটি অংশের পেছনে খরচ করে থাকেন। এই ওয়েব দুনিয়ার এ অংশটিকে সুন্দর করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলে পরিচয় দেওয়া হয়। সত্যি বলতে বর্তমান সময়ের পৃথিবী আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া।
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হল ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটার, গুগল প্লাস, ইন্সটাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, রেড্ডিট, টাম্বলার, পিন্টারেস্ট, ভাইন, লিঙ্কডইন ইত্যাদি। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমগুলো আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। বৈচিত্র্যপূর্ণ সংবাদ ও তথ্যপ্রাপ্তির জন্য সবচেয়ে কার্যকর হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তথ্য পাওয়ার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় নিয়ে মতামত প্রকাশ, মতবিনিময়, আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ থাকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ। পরিচিত মানুষ, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দেশের বাইরে থাকা পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও প্রবাস জীবনের গল্পগুলো জানতে এসব মাধ্যমের দেশের বিপুল সংখ্যক প্রবাসীদের পরিবার ও তাদের বন্ধু-বান্ধবেরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
মুদ্রার উল্টোপিঠটাও এবার দেখা দরকার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর কারণে নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন যোগাযোগ সাইটে নৈতিক অবক্ষয় জনিত ভিডিওগুলোতে প্রবেশকারী অন্যগুলোর থেকে প্রায় ৪০ ভাগ বেশী। আর দর্শকদের ৮০ ভাগ এর বয়সই ১৬-২৩ বছর। তাছাড়া সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করার একটি উত্তম পন্থা হলো এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামগুলি। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এইসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহৃত হয়। ভুয়া ও সাজানো খবর প্রচারেও ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। কিছুদিন আগে আমাদের দেশেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবের উপর ভিত্তি করে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ঘটেছিল।
তাছাড়া উঠতি তরুণদের পড়াশুনার ভরাডুবির পিছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে। এখন তো নতুন ট্রেন্ড পরীক্ষার আগের রাতে সামাজিক মাধ্যমগুলোর পাশাপাশি হাতে হাতে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র। ছাত্র-ছাত্রীর পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ কমাতে এই কারণই যথেষ্ট। তাছাড়া এখনকার তরুণ-তরুণীরা যে হারে ফোন চালাচ্ছে এর ফলে তারা স্বীয় জীবনের অমূল্য সময়গুলো অপচয় করছে, নিজের গুরুত্ববহ সম্ভাবনাকে ধুলিস্যাৎ করছে। অলসতা আর কর্মবিমুখতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সবচেয়ে হাস্যকর কিন্তু নির্মম দিক হল নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হলেও এগুলোই আমাদের সামাজিকতা নষ্ট করে অসামাজিক করে দিচ্ছে। অনলাইননির্ভর এই সামাজিক যোগাযোগ কি বাস্তবে আমাদের অসামাজিক করে ফেলছে? এই প্রশ্ন নিয়ে একটি বিতর্ক ছাড়া হয়েছিল ডিবেট ডট ওআরজি ওয়েবসাইটে। বিতর্কে পশ্চিমা দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরাই মূলত অংশ নিয়েছেন। ফলাফল—৮১ শতাংশ মত দিয়েছেন পক্ষে অর্থাৎ ‘হ্যাঁ’। আর ১৯ শতাংশ বিপক্ষে। অর্থাৎ এই যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আপনাকে আপনার ভাইবোন, মা-বাবা, সঙ্গী, সন্তানের কাছ থেকে আলাদা করে ফেলে। সামাজিকভাবে আপনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন।
এইসব যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন বিশেষ দিনে ব্যবহারকারীদের কার্যক্রম লক্ষ্য করলেই ব্যাপারগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়। মা দিবসে মায়ের সাথে ছবি, ভালোবাসা দিবসে ভালোবাসার মানুষটির সাথে ছবি, পরিবারের সাথে কোন রেস্তোরায় খেতে গেলে সেই জায়গার ছবি আর কোথাও ঘুরতে গেলে সেই জায়গার ছবি এসব যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না করলে এসব ব্যাপারগুলো যেন পূর্ণতা পায় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এইসব ভ্রমণের উদ্দেশ্যই থাকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শো-অফ করা। আর কিছু বিষন্ন মানুষের এই মেকি শো-অফের কারণে এইসব মাধ্যম ব্যবহারকারী আরও বড় একটি অংশ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে অনেকেই নিজের বাস্তব জীবনকেই হারিয়ে ফেলছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। নিজের জাত্যভিমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ না করে নিজের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ক্রীড়নকে পরিণত না হয়ে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে হবে। তবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শো-অফালাইজেশন এড়িয়ে আপনি সোশ্যালাইজেশনের পথে এগিয়ে যেতে পারবেন।

 

 

Post Author: RK Desk

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *