খনা: অভাগা এক ভাগ্যগণকের অাখ্যান

গ্রাম বাংলার কৃষকদের কাছে একটি অতিপ্রচলিত শ্রুতি হচ্ছে……..

ষোল চাষে মুলা,
তার অর্ধেক তুলা;
তার অর্ধেক ধান,
বিনা চাষে পান।

এর মানে কী? ষোলবার চাষ করার মুলো নাকের সামনে ঝুলানো নাকি অর্ধেক চাষে কানে তুলো গোঁজা! নাকি তারও অর্ধেক চাষে ধান বোনা আর চাষ ছাড়াই পান মুখে পোরা!

এই কথার অর্থ হলো- ১৬টি চাষ দিয়ে মুলা বপন করলে ফলন পাওয়া যাবে ভালো। তুলা চাষ করতে হলে এর অর্ধেক চাষ র্অথাৎ ৮টি চাষ দিলেই হবে। ধান রোপণে এত চাষের প্রয়োজন নেই, মুলার অর্ধেক পরিমাণ র্অথাৎ ৪টি চাষ হলেই যথেষ্ট। অন্যদিকে পান উৎপাদন করতে কোনো চাষেরই প্রয়োজন নেই। কৃষিকাজের রীতি-নীতি অল্প কথায় এর চেয়ে ভালো ভাবে আর বোঝানো যায় না।

এসব কথাই খনার বচন নামে পরিচিত।

এখন প্রশ্ন হল খনা কে? খনা বা ক্ষণা জ্যোতিষশাস্ত্রে নিপুণা ও বচন রচয়িতা বিদুষী নারী। তাঁর আবির্ভাবকাল ৮০০ থেকে ১২০০ খিস্টাব্দের মধ্যে অনুমান করা হয়। কথিত আছে তার আসল নাম ‘লীলাবতী’। তার ব্যক্তিগত পরিচয় কিংবদন্তি নির্ভর এবং সে ক্ষেত্রেও আবার দ্বিমত রয়েছে। একটি কিংবদন্তি অনুসারে তার নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসাতের দেউলি গ্রামে। পিতার নাম অটনাচার্য। চন্দ্রকেতু রাজার আশ্রম চন্দ্রপুরে তার বাস।

অপর কিংবদন্তি অনুসারে তিনি ছিলেন সিংহলরাজের কন্যা। শুভক্ষণে জন্মলাভ করায় তাঁর নাম রাখা হয় খনা বা ক্ষণা। এদিকে বাংলার রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহ তার পুত্র মিহিরের জন্মের পর গণনা করে দেখেন যে, মিহিরের আয়ু মাত্র এক বছর। তাই পুত্রকে তিনি একটি পাত্রে রেখে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। পাত্রটি ভাসতে ভাসতে সিংহল দ্বীপে পৌছায়। সিংহলরাজ শিশুটিকে নিয়ে লালন-পালন করেন এবং বয়ঃক্রমকালে খনার সঙ্গে তার বিবাহ দেন। মিহির ও খনা দুজনই জ্যোতিষ শাস্ত্রে পারদর্শিতা অর্জন করেন। অতঃপর মিহির সস্ত্রীক জন্মভূমিতে ফিরে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং পরবর্তীতে তারা একত্রে বসবাস করতে থাকেন।

 

তার নাম কীভাবে খনা হলো তা নিয়ে কিছু মতবাদ রয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুসারে লীলাবতীর জন্ম হয়ছিল এক শুভক্ষণে। এজন্য তিনি ক্ষণা। এখান থেকেই পরবর্তিত হয়ে খনা নামটি এসেছে। আরেকটি ধারণানুসারে খনা নামের উৎপত্তি ভিন্ন। উড়িয়া ভাষায় খোনা মানে হলো বোবা। লীলাবতীর জিভ কেটে দেবার ফলে তিনি বোবা হয়ে যান বলে সেখান থেকে তার নাম খোনা বা খনা হয়ে থাকতে পারে।

খনার জীবনব্যাপ্তি নিয়েও নানা মতভেদ আছে। খনা যদি বরাহের পুত্রবধু হয় তবে তার জন্ম কোনোভাবেই ৮০০ খ্রিস্টাব্দে হবে না। কারণ বরাহের জীবনকাল ৫০৫ থেকে ৫৮৭। আবার খনার জন্ম অত আগে হলে তার বচনের ভাষা এত আধুনিক হতে পারেনা। তবে খনার বচন লিখিত না হওয়ায় তা কালক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে, এমনটা ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক।

আরও একটা প্রশ্ন দাঁড়ায়। খনার বচনে কৃষি, আবহাওয়া, খাদ্য, জ্যোতিষবিদ্যা সম্বন্ধে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলা হয়েছে।

একজন মানুষের পক্ষে এতকিছু জানা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হল, যুগে যুগে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বচন দিয়েছেন। যা তাদের নামে প্রচলিত না হয়ে সব একজনের নামে অর্থ্যাৎ খনার নামের প্রচলিত হয়েছে।

খনার জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় অধ্যায় হচ্ছে তার মৃত্যু। খনার স্বামী মিহির এক সময় বিক্রমাদিত্যের সভাসদ হন এবং পিতার ন্যায় জ্যোতিষশাস্ত্রে প্রতিপত্তি লাভ করেন। একদিন পিতা বরাহ এবং পুত্র মিহির আকাশের তারা গণনায় সমস্যায় পড়লে, খনা এ সমস্যার সমাধান দিয়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি আর্কষণ করেন। গণনা করে খনার দেওয়া র্পূবাভাসে রাজ্যের কৃষকরা উপকৃত হতো বলে রাজা বিক্রমাদিত্য খনাকে দশম রত্ন হিসেবে আখ্যা দেন।

খনার প্রজ্ঞা দেখে তার শ্বশুর বরাহ রাজসভায় তার নিজের অবস্থান হারানোর শঙ্কায় পড়ে যান। ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে তিনি তার পুত্র মিহিরকে আদেশ দেন খনার জিহ্বা কেটে ফেলতে, যাতে সে আর বচন না বলতে পারে। খনা এ আদেশ মেনে নেয়। তবে সে মিহিরকে জানায়, তার কিছু বলার আছে। মিহির অনুমতি দিলে খনা কৃষি, জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে তার লব্ধ জ্ঞান বলা শুরু করে। সেদিনের খনার কথাগুলোকে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। উপস্থিত শ্রোতারা তার কথাগুলোকে শ্রুতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করে। সেগুলোই পরে খনার বচন নামে পরিচিতি পায়। জিহ্বা কেটে নেওয়ার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে খনার মৃত্যু হয়।

আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে থেকে একজন নারীর এমন প্রজ্ঞাকে বরাহ মেনে নিতে পারেনি। তাই এখনো বরাহকে তার হীনমন্যতা ও খনাকে তার অসীম প্রজ্ঞার জন্য মনে রাখা হয়। খনা বহুকাল পূর্বেই বাংলার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বলী হয়ে গেলেও তার বচন এখনো গ্রাম বাংলার কৃষকদের জন্য বেদবাক্যের সমান।

খনার বচনের কিছু উদাহরণ—-

আগে খাবে মায়ে,
তবে পাবে পোয়ে।
অর্থঃ(মা খাবার খেলেই বাচ্চারা খাবার পাবে।)

কলা রুয়ে না কেটো পাত,
তাতেই কাপড়,তাতেই ভাত।
অর্থঃ (কলাগাছের ফলন শেষে গাছের গোড়া না কাটে যেন কৃষক, কেননা তাতেই সারা বছর ভাত-কাপড় জুটবে তাদের।)

যদি বর্ষে আগুন,
রাজা যায় মাগন।
অর্থঃ (আগুনে অর্থাৎ অগ্রাণে আর, মাগুনে মানে ভিক্ষাবৃত্তির কথা বোঝাতে ব্যবহৃত, অর্থাৎ যদি অঘ্রাণে বৃষ্টিপাত হয়, তো রাজারও ভিক্ষাবৃত্তির দশা, আকাল অবস্থায় পতিত হওয়াকে বোঝায়।)

যদি বর্ষে পুষে
কড়ি হয় তুষে।
অর্থঃ (র্অথাৎ পৌষে বৃষ্টিপাতের ফলে কৃষক তুষ বেচেও অঢেল টাকাকড়ির বন্দোবস্ত করবে।)

যদি বর্ষে মাঘের শেষ,
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ
অর্থঃ (মাঘের শেষের বৃষ্টিপাতে রাজা ও দেশের কল্যাণ।)

Post Author: RK Desk

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *