বিয়ে হচ্ছে দুটি মনের মিলন, দুটি পরিবারের মিলন। তাই বিয়েকে একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করা হয়। বিয়ে হচ্ছে হিন্দুধর্মে অতি পবিত্র একটি বিষয়। হিন্দুধর্মে ‘বিয়ে’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই যে কথাটি সবার আগে মনে পড়ে সেটি হচ্ছে শাঁখের আওয়াজ, উলুধ্বনি। মন্ত্রোচারণের ফলে সাতপাক, মালাবদল ও সিঁদুরদানের মাধ্যমে শেষ হয় বিবাহ অনুষ্ঠান। বিয়ে কথাটি শুনলেই আমরা ভাবি যে কোনো পুরুষ টোপর মাথায় দিয়ে বর সেজে বিয়ে করতে আসবে আর লাজে রাঙা কনেটিকে বিয়ে করে নিয়ে নিজের বাড়ি ফেরত যাবে। এটি মূলত বাংলাদেশ কিংবা পশ্চিমবঙ্গের বিবাহের চিত্র। কিন্তু হিন্দু ধর্মে আরো কয়েক প্রকার বিবাহ রীতি প্রচলিত আছে। সেগুলোর প্রচলন অবশ্য বাংলাদেশে কিংবা পশ্চিমবঙ্গে খুব বেশি দেখা যায় না। বিভিন্ন প্রাচীন উপাখ্যানেই সেসকল বিবাহের ধরণ দেখতে পাওয়া যেত। মনুসংহিতায় সর্বমোট আট ধরণের বিবাহের প্রথা পাওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছেঃ
- ব্রাহ্ম বিবাহ
- প্রজাপত্য বিবাহ
- আর্য্য বিবাহ
- দৈব বিবাহ
- অসুর বিবাহ
- গান্ধর্ব বিবাহ
- পিশাচ বিবাহ বা পৈশাচিক বিবাহ
- রাক্ষস বিবাহ
ব্রাহ্ম বিবাহঃ
“শাস্ত্রজ্ঞান সম্পন্ন ও চরিত্রবান পাত্রকে কন্যাপক্ষেরা স্বয়ং আহবান করে যথোচিত অভ্যর্থনা করে কন্যাকে সুচারুবস্ত্রে আচ্ছাদিত করে ও অলংকারে ভূষিত করে ঐ পাত্রকে যদি সম্প্রদান করে তবে তাকে ব্রাহ্ম বিবাহ বলে।”
(মনুসংহিতা ৩য় অধ্যায়, শ্লোক-২৭)
ব্রাহ্ম বিবাহ ছিল ব্রাহ্মণ্য আচার সম্পৃক্ত বিবাহ। বেদে ভালো জ্ঞান আছে এমন সচ্চরিত্র কোনো ব্যক্তির নিকট কন্যা সম্প্রদান করার পদ্ধতিতে যে বিবাহ সম্পন্ন হয় সেটিই মূলত ব্রাহ্ম বিবাহ নামে পরিচিত। প্রধাণত বর্ণ মিলিয়েই এই বিবাহ দেওয়া হয়। কন্যাকে নানাবিধ অলঙ্কারে সজ্জিত করে পাত্রের হাতে সমর্পণ করা হয় এই বিবাহে। বরকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে এই বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। এখানে পণপ্রথাযুক্ত থাকে না।
প্রজাপত্য বিবাহঃ
“তোমরা দুজনে সুখে গার্হস্থ্য জীবনযাপন করো”- এই আশির্বাদের মাধ্যমে বিভিন্ন অলঙ্কারের মাধ্যমে যখন কোনো পাত্রের হাতে কন্যা সম্প্রদান করা হয়, সেটিই হচ্ছে প্রজাপত্য বিবাহ। এ বিবাহে মূলত বরের কাছ থেকে একত্রে গার্হস্থ্য ধর্ম পালন করার প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়। কন্যার ভরণপোষন ও সকল দায়দায়িত্ব বহন করার জন্য পাত্র বিবাহ মণ্ডপেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এরপর কন্যাকে বিভিন্ন অলংকারে সাজিয়ে পাত্রের হাতে সমর্পণ করা হয়। এটি অনেকটা ব্রাহ্মবিবাহের মতোই তবে পিতা কন্যাদানের পূর্বে পাত্রের নিকট সকল ভরণপোষণ বহনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করায়। এ বিবাহ আঈয হিন্দু সমাজে বেশি প্রচলিত ছিল। বর্তমানে বাঙালি হিন্দু সমাজে এই বিবাহ প্রথা চালু রয়েছে।
আর্য্য বিবাহঃ
“পাত্রের কাছ থেকে একটি গাভী বা একটি বৃষ অথবা দুটি গাভী বা দুটি বৃষ নিয়ে যখন সেই পাত্রকে কন্যা দান করা হয় সেটি তখন সেই বিবাহকে আর্য্য বিবাহ বলে”
(মনুসংহিতা ৩য় অধ্যায়, শ্লোক-২৮)
মূলত গাভী বা বৃষের বিনিময়ে যজ্ঞের মাধ্যমে এই বিবাহ দেওয়া হয়। এই বিবাহকে আদর্শ বিবাহ বলে ধরে নেওয়া হয় না। যখন কন্যার পরিবার বিবাহের খরচ বহন করতে ব্যর্থ হতো তখন এই বিবাহের ধরণ দেখা যেত। এই বিবাহ প্রথা বাংলাদেশে প্রচলিত নেই। ভারতের বিহারীদের মধ্যে এই বিবাহের প্রচলন দেখা যায়।
দৈব বিবাহঃ
“যজ্ঞের অনুষ্ঠানকালে সেই যজ্ঞে যিনি পৌরহিত্য করেন তাকে যদি যজ্ঞের আয়োজক সালাঙ্কারা কন্যা দান করেন তবে সেই বিবাহকে দৈববিবাহ বলে”
(মনুসংহিতা ৩য় অধ্যায়, শ্লোক-২৮)
এ বিবাহে যজ্ঞের পুরোহিতকে যজ্ঞ সম্পাদনকালে কন্যা দান করা হয়। কন্যার জন্য দীর্ঘকাল সুপাত্রের সন্ধান না পেলে পিতা যজ্ঞের ঋত্বিককের কাছেই কন্যাদান করা হতো। এ পদ্ধতির প্রচলন কেবল বাংলাদেশেই নয় ভারতবর্ষেও এর প্রচলন দেখা যায় না।
অসুর বিবাহ বা আসুরিক বিবাহঃ
“কন্যাকে পিতা ও অন্য গুরুজনকে যথেষ্ট ধন দানের মধ্য দিয়ে সন্তুষ্টি উৎপাদন করে কন্যাকে পাত্র কতৃক গ্রহণ করাকে অসুর বিবাহ বলে”।
(মনুসংহিতা ৩য় অধ্যায়, শ্লোক-২৯)
এ বিবাহের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক সময় কোনো পুরুষ যদি কোনো তরুণীর দিকে আকৃষ্ট হয় তখন অর্থের সাহায্যে তরুণীর পরিবারকে ভুলিয়ে ঐ তরুণীকে পাওয়ার আকাঙ্খা করে। এ ধরণের বিবাহ সমাজসিদ্ধ নয়।
গান্ধর্ব বিবাহঃ
“পাত্রপাত্রী পরষ্পরের প্রতি অনুরাগবশতঃ যখন দেহ মিলনে আবদ্ধ হয় তখন তাকে গান্ধর্ব বিবাহ বলে। এ বিবাহ পাত্রপাত্রী গুরুজনের অনুমতির অপেক্ষা না করে মৈথুনের ইচ্ছায় ঘটে থাকে”।
(মনুসংহিতা ৩য় অধ্যায়, শ্লোক-৩২)
এ ধরণের বিবাহকে প্রেমের বিবাহের সাথে তুলনা করা হয়। এ বিবাহে গোপনে প্রেম করে ও পরষ্পরের পাণিগ্রহণ করে থাকে। এখানে পিতা মাতার অনুমতি ছাড়াই নিজের ইচ্ছায় বিবাহ সম্পন্ন করে। অনেক সময় স্বেচ্ছায় গোপনে ব্রাহ্মণ ডেকে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে এই বিবাহের কাজ সম্পন্ন করে। এ বিবাহ পিতা মাতার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে করা হয় বিধায় এ বিবাহে পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের তেমন কোনো দায়িত্ব থাকে না।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়ঃ মহাভারতের গঙ্গা আর শান্ত্বনুর বিবাহ ছিল গান্ধর্ব বিবাহ।
পৈশাচ বিবাহঃ
“নিদ্রায় অভিভূতা, মদ্যপানে বিহ্বলা, অপ্রকৃতিস্থা নারীকে নির্জনে নিয়ে গিয়ে পুরুষ যদি বলপূর্বক সম্ভোগ করে থাকে তবে তাকে পৈশাচ বিবাহ বলে”।
(মনুসংহিতা ৩য় অধ্যায়, শ্লোক-৩১)
এ বিবাহ অনেকটা ধর্ষণের প্রতিরূপ। নারীকে মাদকদ্রব্য খাইয়ে অজ্ঞান করে পুরুষ যৌনমিলন করে। পরে নারীটি যখন জানতে পারে তার হাতে অন্য কোনো উপায় নেই , তখন বাধ্য হয়ে ঐ পুরুষটিকেই বিয়ে করে। প্রাচীনকালে এই বিবাহের অনুমোদন দেয়ার অন্যতম কারণ ছিল শাসকগোষ্ঠীর সাথে পুরোহিত গোষ্ঠীর সমঝোতা। তবে বর্তমান হিন্দু সমাজে এ ধরণের বিবাহের কোনো চল নেই।
রাক্ষস বিবাহঃ
“কন্যাকে জোরপূর্বক হরণ করে বিয়ে করাকে রাক্ষস বিবাহ বলা হয়”।
(মনুসংহিতা, ৩য় অধ্যায়, শ্লোক-৩৩)
এ ধরণের বিবাহে কন্যা পিতা-মাতা কারোই মত থাকে না বরং জোরপূর্বক হরণ করে কন্যাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ব্রাহ্মণ ডেকে জোরপূর্বক বিবাহের কাজ সম্পন্ন করা হতো। প্রাচীনকালের রাজপুরুষেরাই রাক্ষস বিবাহ করার মতো শক্তিধর ছিলেন। রাজপুত্রদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় পুরোহিতেরাও এই বিবাহকে সায় দিতেন। প্রাচীনকালে ক্ষত্রিয় রাজারা বহু নারীকে ধরে এনে এভাবে বিয়ে করতো। তবে বর্তমান সমাজে এই বিবাহের চল নেই।
যে আট রকম বিয়ের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম চারটি বিবাহ অর্থাৎ ব্রাহ্ম, প্রজাপত্য,আর্য্য ও দৈব মন্ত্র উচ্চারণের ফলে সম্পন্ন হয়। তবে বর্তমানে বাঙালি বিবাহ পদ্ধতি বলতে প্রজাপত্য বিয়েকেই বোঝানো হয়। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে বসবাসরত বাঙালিরাই এ পদ্ধতিতে ও বিভিন্ন লৌকিক আচারের ভিত্তিতে বিবাহ প্রথা সম্পন্ন করে থাকে। তবে বিবাহ যেহেতু মনের মিল তাই পাত্রপাত্রী নিম্নোক্ত মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়।
“যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্ত হৃদয়ং মম
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্ত হৃদয়ং তব”।
অর্থাৎ, তোমার এই হৃদয় আমার হোক আর আমার এই হৃদয় তোমার হোক। এভাবেই স্বামী স্ত্রী চিরকাল সুখে দুখে একসাথে থাকার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।