গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের নাম আমরা সকলেই শুনেছি। তাঁর দর্শনের সাথে আমরা সকলেই কম বেশি পরিচিত। কিন্তু আপনারা জানেন কি যে সক্রেটিস তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কোনো দর্শন বা মতবাদ লিপিবদ্ধ করেননি? তাঁর শিষ্যরাই তাঁর মতবাদগুলোকে লিপিবদ্ধ করে ও বিশ্বব্যাপী তা প্রচার করে। আমাদের বাংলাদেশেও এমন একজন দার্শনিক ছিলেন যিনি নিজে কিছু লিপিবদ্ধ করে না গেলেও, তাঁর চিন্তাধারা আমাদের সমাজকে আজও প্রভাবিত করে চলেছে। বলছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কিংবদন্তি অধ্যাপক জ্ঞানতাপস ড. আবদুর রাজ্জাক-এর কথা।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর জন্ম ১৯১৪ সালে ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার পারাগ্রামে। বাবা আবদুল আলী চাকরি করতেন ব্রিটিশ ভারতের পুলিশ বিভাগে। বাবার বদলীর চাকরির কারণে ছেলেবেলায় নানা জায়গায় ঘুরেছেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি ঢাকার মুসলিম গভার্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে মেট্রিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৩১ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগে। ১৯৩৬ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভের পর ঐ বছরই রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগে লেকচারার পদে তিনি যোগদান করেন। পরে অবশ্য রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিভাগ ভেঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নামে দুটি পৃথক বিভাগ হলে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান।
১৯৫০ সালে লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স-এ ভর্তি হন আবদুর রাজ্জাক । বিশ্বনন্দিত প্রফেসর হ্যারল্ড লাস্কির অধীনে পিএইচডি করতে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। তবে লাস্কি পরলোকগমন করায় তাঁর থিসিস মূল্যায়ন করার মত কেউ নেই এই বিবেচনায় থিসিস জমা না দিয়েই (অর্থাৎ কোনো ডিগ্রী ছাড়া) দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর সেই থিসিসটি এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসা প্রত্যেকেই অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক কে বলেছেন: “শিক্ষকের শিক্ষক”। এই একটিমাত্র উক্তিতে আমরা বুঝতে পারি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক-এর মননশীলতার গভীরতা। সবসময় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এ মানুষটির সান্নিধ্য পেতে তার কাছে ছুটে আসত সমাজের চূড়ায় অবস্থানকারী লোকেরা। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্যন্ত আসতেন ড. আব্দুর রাজ্জাকের সাথে সলা-পরামর্শ করতে।
সাহিত্যিক আহমদ ছফা তো ড. আব্দুর রাজ্জাককে তার গুরু বলেই মানতেন, এবং তাকে উদ্দেশ্য করে রচনা করেছিলেন গ্রন্থ ‘যদ্যপি আমার গুরু’। আহমদ ছফা ছাড়াও- সলিমুল্লাহ খান, অধ্যাপক আহমেদ কামাল প্রমূখ -ড. রাজ্জাকের ঘরানার সার্থক উত্তরসূরী।
প্রফেসর রাজ্জাক ছিলেন নিভৃতচারী ও বিদ্বান এক ব্যক্তি। উনার জগতে মানুষ থেকে বইয়ের কদর বেশি ছিল। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে বই পড়তে পড়তেই কেটে যেত তাঁর দিনকাল।
তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। বাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব সাধারণ পোশাক পরতেন। বাসায় তাকে দেখা যেত লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আসতেন। চিরকুমার এই ব্যক্তিটি খুব সরল ও নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করতেন।
অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী এই কিংবদন্তি অধ্যাপক অল্প কিছু প্রবন্ধ ছাড়া আর কিছুই রচনা করেননি। অধ্যাপক রাজ্জাকের মোট তিনটি সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়েছে। যার একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সর্দার ফজলুল করিম। তাঁর সাথে সেই আলাপচারিতার ওপর ভিত্তি করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজঃ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা’ বইটি রচনা করেন সর্দার ফজলুল করিম। অন্য দুটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ ও সেলিনা শিরীন সিকদার। তাঁর একটিমাত্র বক্তৃতা লিখিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে, এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে তাঁর অসম্পূর্ণ পি.এইচ.ডি থিসিস।
আসলে আবদুর রাজ্জাক নিজেকে শুধু একজন ‘মাস্টার’ বলেই মনে করতেন, যার কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পড়ানো। কিন্তু কোনো জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি তার কাছে গেলে তিনি তার জন্য নিজের জ্ঞানের দুয়ার পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিতেন। তাঁর অসাধারণ মেধাকে যারা চিনতে পেরেছিল, তারা ঠিকই তাঁর ছায়াসঙ্গী হিসেবে থেকেছে।
১৯৭৩ সালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় আবদুর রাজ্জাককে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী প্রদান করে। ১৯৭৫ সালে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন ড. আবদুর রাজ্জাক এবং একই বছরে তিনি বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে ভূষিত হন।
আবদুর রাজ্জাকের মৃত্যু ১৯৯৯ সালের ২৮ নভেম্বর। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছেন খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। তাঁর ছাত্রছাত্রীরা, তাঁর সান্নিধ্যে যারা এসেছেন, তারা। কিন্তু সরাসরিভাবে না হলেও, তাঁর অনুসারীদের মাধ্যমে ড. আবদুর রাজ্জাকের চিন্তা ধারা আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই ইতিহাস অধ্যাপক ড. আবদুর রাজ্জাককে জ্ঞানের এক মৌন পাহাড় হিসেবে মনে রাখবে।