বাউল সম্প্রদায়: বাঙ্গালী চিরায়ত সংস্কৃতির ধারক

গেরুয়া বসনে একতারা হাতে টুংটাং করতে করতে হেটে যাওয়া মানুষদের দেখলেই একটা বিশেষ শ্রেনীর কথা মানসপটে ভেসে ওঠে। হ্যাঁ, বাউল ফকিরদের কথাই বলছি। বাউল লোকসম্প্রদায়ের একটি সাধন-ভজন গোষ্ঠী, যারা গ্রামে-গঞ্জে গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা গেলেও সাধারণত কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর এবং পাবনা অঞ্চলেই এদের বেশি দেখা যায়। বাউলরা দেহভিত্তিক গুপ্ত সাধনার অনুসারী। এই সাধনায় সহজিয়া ও সুফি সাধনার সম্মিলন ঘটেছে; তবে সুফি ভাবনার প্রভাবই বেশি।

খুব সম্ভবত ৯০০-৯৫০ খ্রিস্টাব্দে উপমহাদেশে বাউল-ফকিরদের আগমন শুরু হয়। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে সূদুর মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতের সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে বাউলদের স্থায়ী বসবাস শুরু হয়। বাউল তত্ত্বের মূল কথা হলো ঈশ্বরের সন্ধান। প্রত্যেক ধর্মে সৃষ্টিকর্তাকে বিশেষ নামে ডাকা হয়। বাউল শব্দের ব্যাখা নানা জন নানাভাবে দিয়ে থাকেন। বাউল শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ বলেন ‘বাতুল’ থেকে ‘বাউল’ হয়েছে, কারো মতে ‘বজ্রী’ থেকে কিংবা ‘বজ্রকুল’ থেকে বাউল শব্দটি এসেছে। কেউ কেউ বলেন ‘আউল’ শব্দ থেকে ‘বাউল হয়েছে। অারেক মত অনুসারে, বাউল একটি ফারসি শব্দ। ‘বা’ এরঅর্থ আত্মা এবং ‘উল’ অর্থ সন্ধান। যার পূর্ন অর্থ আত্মার সন্ধান।

ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধববিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন। হিন্দুরা ভগবান, মুসলমানেরা আল্লাহ, খ্রিস্টানেরা স্রষ্টাকে ঈশ্বর বলে সম্বোধন করে। কিন্তু বাউল-ফকিরদের বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তার বাস মানব মনের ভিতর। তাকে যেভাবে, যে নামেই ডাকা হোক না কেনো তিনি সেই ডাকে অবশ্যই সাড়া দিবেন। মূলত বাউল-ফকিররা বিভিন্ন ভক্তি গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্ধান করেন। মোঘল আমলে দিল্লি-আহমেদাবাদে তাদের কদর বাড়তে থাকে। এমনকি সম্রাট বাবরের সময়কালে দিল্লিতে আজমেরি শরিফ মাজার স্থাপন করা হয়, যেখানে ফকিরেরা সুফি গানের মাধ্যমে ঈশ্বর ভক্তি করতো। সম্রাট হুমায়ন বাউল-ফকিরদের জন্য তার রাজ্যে আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

বাউলেরা মূলত দুই শ্রেনীর। যাদের হিন্দু -বৌদ্ধ সহজীয় প্রভাব রয়েছে তাদের বলা হয় বৈষব বাউল। এরা যেমন গৌতম বুদ্ধ এবং সনাতন হিন্দু ধর্মের মূল তত্ত্বের সমন্বয়ে নিজস্ব ধর্ম গড়ে তুলেছে। এরা বিশ্বাস করে ভগবান এই মহাজগতের স্রষ্টা তাই তারা তার সন্ধান পাবার আশায় বুদ্ধের মতো করে বৃক্ষ তলে বসে সংগীতের মাধ্যমে তার আরাধনা করে। যারা ফকির শ্রেনীর তাদের আমরা বৈরাগী বলে থাকি। এদের মধ্যে মুসলিম-বৌদ্ধ সহজীয় প্রভাব রয়েছে। এদের সংগীতে রয়েছে যেমন আল্লাহ-খোদার গুনকীর্তন, আবার তারা গৌতম বুদ্ধের জীবন-যাপন পদ্ধতি অনুসরণ করে। লম্বা-গোফ দাড়ি রেখে, লতা-পাতা ভোজের মাধ্যমেই তারা জীবন কাটায়।

উপমহাদেশে অনেক বিখ্যাত বাউল-ফকিরদের আগমন ঘটেছে।এদের মধ্যে কালা-চান দরবেশ,বাবা-ফকির শাহজালাল-শাহপরান, বাউল হাসন, ফকির লালন শাহ জগদ্বিখ্যাত। অবশ্য এদের মধ্যে ফকির লালন একটু ভিন্ন গোত্রের সাধক ছিলেন। তিনি একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন স্রষ্টা বাস করেন মানব আত্মায়। তার মতে মসজিদ, মন্দির, গির্জা ছিলো ধর্মের ভন্ড রুপ।
বর্তমান সমাজে বাউল -ফকিরদের কদর অনেক বেড়েছে। পুরান ঢাকা, আজমেরি শরিফ, লালনের আঁখড়ায় এ ধরনের সাধকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় যাদের আমরা ‘মুরিদ’ বা ‘খাজা বাবা’ বলে থাকি। বিখ্যাত মনিষী রামসন্না বলেছিলেন সারা বিশ্বে একদিন বাউল-ফকিরেরা প্রভাব বিস্তার করবে। আজ তারা গানের মাধ্যমে ঈশ্বরের আরাধনার নামে মোটা অংকের অর্থ উপার্জন করে। এভাবে তারা সমাজে ভন্ডরুপে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে।

বাউল গানে নানা তত্ত্বকথা আছে যেমন দেহতত্ত্ব, গুরু বা মুর্শিদতত্ত্ব অথবা নবীতত্ত্ব, লীলা অথবা মনের মানুষ তত্ত্ব ইত্যাদি। প্রতি গানে দুটি পদ থাকে দেহতত্ত্ব এবং ভজনতত্ত্ব। বাউলরা নিজেদের ভাষায় এ দুটিকে উপর পদ এবং নিচের পদ বলে উল্লেখ করে। বাউল গানের সুরে কখনও কখনও ভাটিয়ালি সুরের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ মাঝিমাল্লারাও অনেক সময় নৌকা বাইতে বাইতে ধীর লয়ে এ গান গেয়ে থাকে। বাউল গানের বিশেষত্ব এই যে, এ গান কেবল বাউল সাধকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাউলের সাধন-ভজন জানে না এমন সাধারণ মানুষও অধ্যাত্মরসের কারণে এ গান নিজের করে নিয়েছে।

Post Author: Saad Dhrubo

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *