২০ এপ্রিল, ২০১৮।
ওমানের এক হোটেলরুমে মারা গেলেন ২৮ বছর বয়সী সুইডিশ এক যুবক। না, কোনো আততায়ীর হাতে তার মৃত্যু ঘটেনি। না, সে আত্মহত্যাও করেনি। বরং দীর্ঘকাল পাঞ্জা লড়ে হার মেনেছে অসুখের কাছে। কিন্তু এরকম অতি স্বাভাবিক এক মৃত্যুর খবর মুহূর্তে পুরো পৃথিবীতে চাউর হয়ে গেলো। হাজারো মানুষের শোকবার্তায় সয়লাব হয়ে গেলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কারণ মৃত সুইডিশ যুবক আপনার আমার মতো সাধারণ কেউ নয়। সে হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ডান্স মিউজিক (ই.ডি.এম) এর সবথেকে জনপ্রিয় ও পরিচিত শিল্পী টিম বার্গলিন, ওরফে ‘Avicii’। তার এই অকালপ্রয়াণে তার ভক্তরা সবাই শোকে স্তব্ধ। তার সহ কুশলীরাও তার মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন করেছেন এবং শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করছেন। কিন্তু এই টিম বার্গলিন কীভাবে পরিণত হলেন “Avicii” তে? অাসুন, জেনে নেয়া যাক।
Avicii নামে অধিক পরিচিত হলেও তার আসল নাম টিম বার্গলিন। ১৯৮৯ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর সুইডেনের স্টকহোম শহরে টিম জন্মগ্রহণ করে। তার মা অ্যানা লিডেন একজন বিখ্যাত সুইডিশ অভিনেত্রী। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই টিম তার বড় ভাইকে অনুসরণ করে ডিস্ক জকি (ডিজে) হিসেবে কাজ করা শুরু করে।
তার Avicii ছদ্মনামের পিছনে একটি কাহিনী আছে। আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মাইস্পেস-এ অ্যাকাউন্ট করার সময় টিম দেখল যে তার নামে একটি আক্যাউন্ট আগে থেকেই করা আছে। তখন টিম Avicii নাম দিয়ে তার আক্যাউন্টটি তৈরি করল। Avicii শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘বৌদ্ধদের সবথেকে নিচুস্তরের নরক’।
২০০৭ থেকে Avicii গানের জগতে প্রবেশ করলেও, প্রথমবারের মত জনপ্রিয়তা পায় ২০১০ সালে ‘ Seek Bromance’ গানের মধ্য দিয়ে। এই গানটি বেশ কয়েকটি ইউরোপিয়ান দেশের টপ ২০ চার্টে উঠে আসে। ২০১১ সালে Avicii-এর ‘Levels’ গানটি প্রকাশ পায়। গানটি বিশ্বব্যাপী প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারপর ২০১৩ সালে ডেভিড গুয়েটা এর সাথে একত্রে Avicii-র ‘Wake Me Up’ গানটি প্রকাশ পায়। গানটি শ্রোতা ও সমালোচকদের দ্বারা সমাদৃত হয়। ‘Wake Me Up’ টানা ১৪ সপ্তাহ বিলবোর্ড ই.ডি.এম মিউজিকের টপ চার্টে শীর্ষ অবস্থানে থাকার রেকর্ড তৈরি করে। একই সালে প্রকাশিত ‘Hey Brother’ গানের জন্য Avicii এম টিভি ইউরোপিয়ান মিউজিক অ্যাওয়ার্ডসে ‘বেস্ট ইলেক্ট্রনিক মিউজিক’ পুরষ্কার পান।
কিন্তু জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পাশাপাশি টিম বার্গলিনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। আসলে অতিরিক্ত কাজের ধকল তার শরীর সইতে পারছিল না। ২০১১-র জানুয়ারি থেকে ২০১৬-র জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ ২৬১ সপ্তাহে Avicii পুরো বিশ্বব্যাপী ২২০টি স্টেজ শোতে পারফর্ম করে। আর নিজেকে ইন্ট্রোভারটেড মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়া টিমের জন্য হাজার হাজার শ্রোতার সামনে এতগুলো শোতে পারফর্ম করা খুব কঠিন ছিল। কাজের এই চাপকে সামলাতে টিম প্রচুর মদ্যপান করা শুরু করে। এমনকি শো শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে কিংবা বিরতির মধ্যেও তাকে মদ্যপান করতে দেখা যেত।
অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য ২০১৩ সালে Avicii-র অ্যাকিউট প্যানক্রিয়েটাইটিস ধরা পরে। ২০১৪ সালে তার গলব্ল্যাডার অপসারণ করতে হয়।
নিজের শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে ২০১৬ সালের মার্চ মাসের ২৯ তারিখে Avicii স্টেজ পারফরমেন্স থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কনসার্ট না করে তিনি শুধু স্টুডিওতে নতুন গান বানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে Avicii-র নতুন স্টুডিও অ্যালবাম Avīci (01) প্রকাশিত হয়।
২০১৮-র এপ্রিলের ২০ তারিখে ওমানে অবস্থানকালে আকস্মিকভাবে তার মৃত্যু ঘটে। তাকে তার হোটেল রুমে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রাথমিক তদন্তে ওমান পুলিশ Avicii-র মৃত্যুতে কোনো অপরাধী কার্যক্রমের প্রমাণ পায়নি। তার মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে যে দীর্ঘকালীন অসুস্থতার জেরেই তার মৃত্যু ঘটেছে।
আসলে কনসার্টে পারফর্ম করা ছেড়ে দিলেও Avicii তার অ্যালকোহল আসক্তিকে ত্যাগ করতে পারেননি। মৃত্যুর আগের রাতেও তাকে মদ্যপানরত অবস্থায় দেখা গিয়েছিল।
মাত্র ২৮ বছর বয়সেই বিশ্বের সবথেকে বিখ্যাত ই.ডি.এম শিল্পীর মৃত্যুতে পুরো সঙ্গীত জগৎ স্তব্ধ। তার দেখানো পথেই ই.ডি.এম সঙ্গীত পেয়েছিল এক নতুন পরিচয়। তার মৃত্যুতে বিশ্বসঙ্গীত জগতের হয়ে গেল এক অপূরণীয় ক্ষতি । কিন্তু Avicii বেঁচে না থাকলেও, তার অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে তিনি তার ভক্তদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। আর ই.ডি.এম মিউজিকের পুরোধা হিসেবে Avicii নামটি চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।