বই রিভিউঃ চিলেকোঠার সেপাই

চিলেকোঠার সেপাই
লেখকঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৬
প্রকাশকঃ ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড

সালটা ১৯৬৯,
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু। তাকে মুক্ত করার জন্য উত্তাল পুরো দেশ। এই আন্দোলন ঢাকা থেকে এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সমাজের সর্বত্র জেগে উঠছে এক পরিবর্তনের জোয়ার। সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোকেরা এই নতুন প্রেক্ষাপটে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যস্ত। শ্রমিক শ্রেণী তখন শোষণহীন সমাজের স্বপ্নে আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে জড়িয়ে পড়েছে। আর সবসময় গা বাঁচিয়ে চলা মধ্যবিত্তরা তখন নিজেদের অবস্থান নিয়ে সন্দিহান। এমনই এক জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিকে নিপুণভাবে তুলে ধরে বাংলাদেশের সাহিত্য ইতিহাসের সবথেকে সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাস, ‘চিলেকোঠার সেপাই’ রচনা করেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।

উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে উসমান ওরফে রঞ্জু। সে ঢাকার এক ঘিঞ্জি গলিতে বাস করা অফিসের এক জুনিয়র কর্মচারী। তার দুই বন্ধু বামপন্থী আনোয়ার আর ডানপন্থী আলতাফ। প্রায়ই তারা মেতে উঠে তুমুল রাজনৈতিক তর্কে, যেখানে রঞ্জু থাকে এক নীরব শ্রোতা হয়ে। রঞ্জুর ভাড়া বাসার মালিক আবার একজন আইয়ুবপন্থী মহাজন রহমতউল্লাহ। আর মহাজনের রিকশা গ্যারাজের মিস্ত্রি খিজির উরফে হাড্ডি খিজির। রঞ্জু, খিজির ও আনোয়ারকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে উপন্যাসটির কাহিনী।
গল্পের প্রথমে স্পটলাইট থাকে রঞ্জুর উপর। সে হচ্ছে আমাদের সমাজের স্বার্থান্বেষী মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি। নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করাই তার প্রধান কাজ। কিন্তু তার চারপাশের আন্দোলন তাকে ভাবতে বাধ্য করে। ঢাকার রাস্তার আন্দোলনরত জনগণের মাঝে সে যেন দেখতে পায় হাজার বছর ধরে নিপীড়িত হয়ে আসা মানুষদের। পর্তুগীজ মগদের হাতে, আরব সুলতানদের হাতে, ব্রিটিশ বেণিয়াদের হাতে নিপীড়িত মানুষদের সে দেখতে পায় মিছিলে। শোষকদের হাত থেকে মুক্তির জন্য তারা যেন মৃত থেকে জেগে উঠে শ্লোগান দিয়ে মিছিল করছে ঢাকা শহরের রাস্তায়। তার ছোট্ট ঘরে বদ্ধ অবস্থায় সে শুধু এই আন্দোলন নিয়ে ভাবতে থাকে। তার নিজের ভীরুতা তাকে ভাবায়, ভাবায় চারপাশের মানুষদের সংগ্রাম । কিন্তু প্রত্যক্ষ সংগ্রামে তাকে খুব কমই দেখা যায়। ধীরে ধীরে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকে রঞ্জু। আর রঞ্জুই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে গল্পের চিলেকোঠার সেপাই।
মহাজনের আশ্রয়েই বেড়ে ওঠা হাড্ডি খিজির উপন্যাসের অন্যতম প্রণিধানযোগ্য চরিত্র। মহাজনের রিকশা গ্যারাজে কাজ করে সে। তার মা ও স্ত্রী দুইজনই ছিল মহাজনের ভোগ্য। মহাজনের প্রতি তীব্র ঘৃণা থেকেই সে যোগ দিয়েছিল আন্দোলনে। কিন্তু পরবর্তীতে তার নেতৃত্বে অন্য শ্রমজীবীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। আসলে তার মত অন্যরাও সমাজের উঁচু শ্রেণীর শাসনের উপর তীব্র ক্ষোভ থেকেই এই আন্দোলনে যোগ দেয়। উপন্যাসে খিজিরের চরিত্রটি তাই হয়ে উঠেছে সমাজের শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের প্রতীক।
রঞ্জুর বামপন্থী বন্ধু আনোয়ার ঠিক সেসময় ঢাকা ছেড়ে চলে যায় গ্রামে। গ্রামের আন্দোলনকে সে নিজ চোখে দেখতে চায়। ডানপন্থী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য আনোয়ার নিজে সামন্তবাদ বিরোধী। সমাজের শ্রেণী বৈষম্য ভাঙতে সে বদ্ধপরিকর। কিন্তু গ্রামে সে দেখতে পায় পুঁজিবাদের এক ভিন্ন রূপ। তার বাবার বাল্যকালীন বন্ধু ও তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় খয়বার গাজী তাদের গ্রামে এক ত্রাশের রাজত্ব কায়েম করেছেন। কিন্তু পরিবর্তনের বাতাস তখন শহর ছেড়ে গ্রামেও চলে এসেছে। চাষীরা এখন মহাজনের শোষণের বিরুদ্ধে দাড়ানো শুরু করেছে। আনোয়ার তাদের সাথে যোগ দেয়। সে তাদের এই সংগ্রামে সম্পৃক্ত হতে চায়। কিন্তু খয়বার গাজীর সাথে পেরে উঠা এতো সহজ নয়।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ১৯৬৯-এর সময় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর অবস্থান সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন তার এই উপন্যাসে। তাঁর নির্মোহ বিবরণীতে সে সময়কার বিভিন্ন গোষ্ঠীর পরিচয়, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাঠকের সামনে চলে এসেছে। তাঁর সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, বর্ণনাময় লেখার ভঙ্গি পাঠককে সে সময়ে নিয়ে যাবে।

যারা ১৯৬৯-এর উত্তাল দিনগুলোর বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চান, তারা অবশ্যই ‘চিলেকোঠার সেপাই’ পড়ে দেখতে পারেন। ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের এত নির্মোহ ও নাটকীয় বিবরণ আমাদের সাহিত্য জগতে দ্বিতীয় পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক চলবে বহুকাল।

Post Author: Ashfaq Niloy

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *