সিলভেস্টার স্ট্যালোন: জীবনযুদ্ধে জয়ী এক অভিনেতার গল্প

একজন অভিনেতাকে চলচ্চিত্র জগতে অমর করে রাখার জন্য অনেকসময় একটি বিখ্যাত চরিত্র যথেষ্ট হয়। স্পাইডার ম্যান হিসেবে টবি ম্যাগুয়ার, হ্যারি পটার হিসেবে ড্যানিয়েল র‍্যাডক্লিফ আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাকের ভাই চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর। কিন্তু এক্ষেত্রে সিলভেস্টার স্ট্যালোনকে ভাগ্যবান বলতে হয়। কারণ এই হলিউড অভিনেতা একইসাথে দুইটি বিখ্যাত চরিত্র বক্সার রকি ব্যালবোয়া এবং সামরিক অফিসার র‍্যাম্বোর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। কিন্তু সাফল্যের চূড়ায় পৌছানোর আগে তাঁকে পেরোতে হয় অসংখ্য বাঁধা। জন্মকালীন জটিলতার জন্য স্পষ্টভাবে কথা বলতে না পারা, বাবা-মা-এর মধ্যকার কলহ, নিউ ইয়র্ক শহরে গৃহহীন হয়ে বাস স্ট্যান্ডে রাত কাটানো, এমনকি শেষ পর্যন্ত নিজের প্রিয় কুকুরকেও বিক্রি করে দেয়া এরকম নানান প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে সিলভেস্টারকে। কিন্তু এতসব প্রতিকূলতা তাঁকে থামাতে পারে নি। চলচ্চিত্র পর্দার রকির মতই বারবার প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ান সিলভেস্টার তিনি হয়েছেন হলিউডের বাণিজ্যিক ঘরানার ছবির প্রবাদতুল্য অভিনেতা।

জন্ম ও বেড়ে উঠাঃ

সিলভেস্টারের জন্ম হয় ম্যনহ্যাটন, নিউ ইয়র্কে ১৯৪৬-এর ৬ই জুলাই। তাঁর বাবা, ফ্র্যানচেস্কো স্ট্যালোন ছিলেন একজন ইটালিয়ান হেয়ার ড্রেসার, আর মা জ্যাকলিন স্ট্যালোন ছিলেন একজন আমেরিকান জ্যোতিষী। জন্মকালীন জটিলতার জন্য ডাক্তাররা তার সিজারিয়ানে দুইটি অতিরিক্ত ফরসেপ ব্যবহার করেন। অসাবধানতাবশত এর মধ্যে একটি ফরসেপ সিলভেস্টারের একটি নার্ভ ছিন্ন করে ফেলে। আর সেকারণেই সিলভেস্টারের মুখের নিচের কিছু অংশ অবশ হয়ে যায়। এই দুর্ঘটনার জন্যই সিলভেস্টারের কথা বলায় কিছুটা অস্পষ্টতা থেকে যায়।

সিলভেস্টারের বাবা-মার দাম্পত্য জীবন মোটেই সুখের ছিল না। তাদের মধ্যে সবসময় কলগ-বিবাদ লেগেই থাকত। আর তাঁর কারণেই ১৯৫৭ সালে তারা আলাদা হয়ে যান আর সিলভেস্টার তাঁর বাবার সাথে মেরিল্যান্ড স্টেটে থাকা শুরু করে। পড়াশোনায় সবসময় পিছিয়ে থাকায় কিছু বছর পর সিলভেস্টার ফিলাডেলফিয়ায় মা ও তার দ্বিতীয় স্বামীর সাথে থাকা শুরু করেন ও সেখানেই তাঁকে পড়াশোনায় পিছিয়ে থাকা ও বখে যাওয়া ছাত্রদের জন্য বিশেষ স্কুলে ভর্তি করানো হয়।

স্কুলের পাঠ চুকিয়ে সিলভেস্টার প্রথমে সুইজারল্যান্ডে ‘আমেরিকান কলেজে’ নাট্য বিভাগে ভর্তি হোন আর তারপর ইউনিভার্সিটি অফ মিয়ামিতে আবারো একই বিষয়ে ভর্তি হোন। কিন্তু ডিগ্রির পাঠ অসম্পূর্ণ রেখেই সিলভেস্টার নিউ ইয়র্ক শহরে চলে যান অভিনয় জগতে পা রাখার জন্য।

আমি পৃথিবীর সবথেকে ধনী, বুদ্ধিমান বা প্রতিভাশালী কেউ নই। কিন্তু আমি সবসময় চেষ্টা করতে থাকি, করতে থাকি এবং করতেই থাকি। আর সে কারণেই আমি সফল।– সিলভেস্টার স্ট্যালন

অভিনেতা হওয়ার সংগ্রামের শুরু

নিউ ইয়র্কে আসার পর অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার জন্য একের পর এক কাস্টিং অডিশনে যেতে থাকেন সিলভেস্টার। কিন্তু কোথাও অভিনয়ের সুজোগ পাচ্ছিলেন না । সেই সময়ে অভিনয়ের পাশাপাশি স্ক্রিপ্ট লেখার কাজও শুরু করেন তিনি।

নিউ ইয়র্ক শহরে টিকে থাকার জন্য স্ট্যালোন নানা কাজে জড়িয়ে পরেন। একসময়ে তিনি চিড়িয়াখানার সিংহের খাঁচা পরিষ্কার করার কাজ, সিনেমা থিয়েটারে দর্শকদের আসন দেখানোর কাজও করেছেন। ১৯৭০ সালে তার আর্থিক অবস্থা এতটাই করুণ হয়ে গিয়েছিল যে বাধ্য হয়ে সিলভেস্টার ‘The Party at Kitty and Stud’s’ নামের এক নীল ছবিতে অভিনয় করেন। সেখানে কাজ করা নিয়ে সিলভেস্টার বলেন,

“আমার অবস্থা তখন এতই খারাপ ছিল যে আমাকে হয় সেই ছবিতে কাজ করতে হত নাহলে ছিনতাই করতে হত।”

১৯৭১ সালে দুটি ‘Bananas ও ‘Klute নামের দুইটি মূলধারার সিনেমাতে ছোট চরিত্রে তাঁকে দেখা যায়। এর তিন বছর পর ‘The Lords of Flatbush’ সিনেমাতে তাকে আরো বড় চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়।

রকি ও তারকাখ্যাতি লাভ

অভিনয়ের চেষ্টার পাশাপাশি সিলভেস্টার চিত্রনাট্য লেখা কাজও চালাতে থাকেন। ১৯৭৫ সালে মোহাম্মদ আলী ও চাক ওয়েপনারের এক বক্সিং ম্যাচ দেখে সিলভেস্টার রকি বালবোয়া নামের এক বক্সারকে নিয়ে লেখার অনুপ্রেরণা পান। তারপর মাত্র তিনদিনের মধ্যে তিনি সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন।

Rocky III-এর একটি দৃশ্যে সিলভেস্টার
Rocky III-এর একটি দৃশ্যে সিলভেস্টার

তাঁর চিত্রনাট্য তিনি একাধিক প্রযোজকদের কাছে নিয়ে যান এবং অনেকেই সেটির ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু সিলভেস্টারের শর্ত ছিল যে তাকেই রকির চরিত্রে অভিনয় করতে দিতে হবে নাহলে চিত্রনাট্যটি তিনি বিক্রি করবেন না। শেষ পর্যন্ত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘United Artists’-এই শর্তে রাজি হয়।

সেই সময়ে আর্থিক অনটনে পরে সিলভেস্টার নিজের পোষা কুকুর বাটকাসকে মাত্র ৫০ ডলারে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। রকির চিত্রনাট্যের জন্য পাওয়া অর্থ দিয়ে প্রথমেই তিনি তাঁর সেই বাটকাসকে আবারো কেনার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাটকাসকে ফিরে পেতে তার নতুন মালিককে ৩,০০০ ডলার দেয়া লাগে। রকি ছবিতে রকির সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে যে কুকুরকে দেখা যায় সেই হচ্ছে বাটকাস।

বাটকাসের সাথে রকি
বাটকাসের সাথে রকি

মাত্র ২৮ দিনে রকির শুটিং শেষ হয়।১৯৭৬ সালে নভেম্বর মাসের ২১ তারিখে রকি মুক্তি পায় এবং প্রথম সপ্তাহে ৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করে, যা তাঁর বাজেটের পাঁচ গুণ। রকি শেষপর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ২২৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার আয় করে, ১০টি অস্কারের জন্য নমিনেশন পায় এবং সেরা চলচ্চিত্রসহ তিনটিতে জয়লাভ করে।

রকির চরিত্রে সিলভেস্টারকে পরবর্তীতে ‘Rocky II’ ( ১৯৭৯), ‘Rocky III’ (১৯৮২), ‘Rocky IV’ (১৯৮৫), Rocky V (১৯৯০) এবং Rocky Balboa'(২০০৬) ছবিতে দেখা যায়। ২০১৫ সালে রকি ফ্র্যাঞ্চাইজের স্পিনঅফ হিসেবে ‘Creed’ মুক্তি পায় যেখানে সিলভেস্টার আবারো রকির ভূমিকায় অভিনয় করেন। সেই ছবিটির দ্বিতীয় ইনস্টলমেন্ট ‘Creed II’ ২০১৮ সালে মুক্তি পায়।

র‍্যাম্বো ও অ্যাকশন হিরো হিসেবে পদার্পণ

১৯৮২ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ফেরত এক আমেরিকান যোদ্ধা, র‍্যাম্বোর চরিত্রে দেখা যায় সিলভেস্টারকে ‘First Blood’ সিনেমায়। সেখানে তাঁর মারদাঙ্গা অ্যাকশন তাঁকে হলিউডের সেরা অ্যাকশন হিরোর কাতারে ফেলে দেয়।

র‍্যাম্বো রূপে সিলভেস্টার
র‍্যাম্বো রূপে সিলভেস্টার

র‍্যাম্বোর জনপ্রিয়তার কারণে পরবর্তীতে রকির মত এই ছবিরও একাধিক কিস্তি ‘Rambo: First Blood Part II’ (১৯৮৫), ‘Rambo III’ (১৯৮৮), ‘Rambo’ (২০০৮) মুক্তি পায়। র‍্যাম্বো চরিত্রে সিলভেটারকে আরো একবার দেখা যাবে ২০১৯-এ মুক্তি পেতে যাওয়া ”Rambo: Last Blood’-এ।

সম্মাননাঃ

অভিনয়ের জন্য সবসময় খুব সমাদৃত হননি সিলভেস্টার। তার অভিনীত চরিত্রগুলো যতটা দর্শকেরা লুফে নিয়েছে ঠিক সেভাবে বিশ্লেষকরা সমাদর করে নি। তা সত্ত্বেও সিলভেস্টারের ঝুলিতে ২০১৫ সালে ‘Creed’-এর জন্য গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, ড্যাভিড ডি ডোনাটেলো অ্যাওয়ার্ড (১৯৭৬), গোল্ডেন ক্যামেরা অ্যাওয়ার্ড (২০০৪), হলিউড ফিল্ম ফেস্টিভালের ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ (২০১০) ছাড়াও অসংখ্য সম্মাননা রয়েছে।

দারিদ্র্য, ব্যর্থতা, আর্থিক দুরবস্থা ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতা পেরিয়েও সিলভেস্টার নিজের পরিশ্রমের মাধ্যমে হলিউডের প্রথম সারির অভিনেতা এবং বিশ্বব্যাপী এক মহাতারকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ব্যর্থতা থেকে হার না মেনে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোতে থাকাই যে সাফল্য লাভের মূল চাবিকাঠি তা সিলভেস্টারের জীবন থেকে আমরা দেখতে পাই।

কেউই কোনোকিছুতে ব্যর্থ হতে চায় না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে আমার ব্যর্থতা আমাকে সাহায্য করেছে।আমাকে জীবনের শিক্ষাগুলো দিয়েছে।- সিলভেস্টার স্ট্যালোন

Reference:
Retrieved from- https://www.powerofpositivity.com/the-tragic-and-uplifting-story-of-sylvester-stallone-revealed/
Retrieved from- https://www.biography.com/actor/sylvester-stallone
Retrieved from- https://www.scoopwhoop.com/Sylvester-Stallone-Life-Story/

Retrieved from- https://en.wikipedia.org/wiki/Sylvester_Stallone

Retrieved from- https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_awards_and_nominations_received_by_Sylvester_Stallone

Post Author: Ashfaq Niloy

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *