একজন বার্সা ফ্যানের চোখে রোনালদো

২০০৬ সালে জার্মানি বিশ্বকাপ থেকেই ফুটবল খেলাটা বুঝে দেখা শুরু করি। তখন রোনালদো বলতে শুধু ব্রাজিলের রোনালদোকেই  চিনতাম। সেই বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মত জানতে পারি যে রোনালদো নামে নাকি আরেকটা খেলোয়াড় আছে, যে খেলে পর্তুগালের হয়ে। তার পুরো নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। 

বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগ একটু একটু দেখা শুরু করলাম। জার্সির কালার আর নামটা ভালো লাগায় চেলসিকে সাপোর্ট করা শুরু করলাম। পেপারে দেখলাম চেলসি সেই বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ নামে কোন একটা টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছে। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিনিসটা কি জানতাম না, কিন্তু চেলসি ফাইনালে খেলবে শুনে খুব ভালো লাগল। পেপারে পড়লাম ফাইনালে তাদের বিপক্ষে খেলবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। সেই দলের খেলোয়াড়দের তালিকায় আবারো সেই নামটা দেখলাম। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। সেই ম্যাচটা সরাসরি দেখতে পারিনি। ফাইনালের পরের দিন নাকি আরো একদিন পরে, ঠিক মনে নেই, খেলার ফলাফল জানতে পারলাম। আমার দল চেলসি হেরে গেছে, আর জিতেছে পর্তুগালের রোনালদোর দল। সেদিন শিরোপা হাতে ওই লোকটার ছবি দেখে কতটা বিরক্ত হয়েছিলাম তা বলতে চাই না। আর সে বছর এই রোনালদোই কিনা পেয়ে গেল বিশ্বের সেরা ফুটবলারের খেতাব ব্যালন ডি অর।

রোনালদোর সাথে আমার পরবর্তী সাক্ষাৎ হয় ২০০৯ সালে। ততদিনে প্রিমিয়ার লিগের চেলসির পাশাপাশি স্পেনের লা লিগার আরেকটি দলের খেলায় আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। এতদুর পর্যন্ত যারা লেখাটা পড়েছেন তাদেরকে মনে হয় না নতুন করে বলবার প্রয়োজন আছে কোন দলটির কথা বলছি। জাভি, ইনিয়েস্তা, পুয়োলরা তখন পেপ  গার্দিওলার কোচিং-এ টিকি টাকার ছন্দে মনোমুগ্ধকর ফুটবল খেলছিল। আর সেই তারকায় ভরা বার্সেলোনা দলের সবথেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিল লিওনেল মেসি। ফুটবল খেলা যে একটা শিল্প হতে পারে সেটা আমি বার্সেলোনার খেলা দেখেই প্রথম উপলব্ধি করলাম। আর মেসিকেই মনে প্রাণে বিশ্বের সেরা ফুটবলার বলে মেনে নিলাম।

আমার বার্সেলোনা ভক্ত বনে যাওয়ার কিছুদিন পরেই আরেকটা খবর পেলাম। পর্তুগালের সেই রোনালদো নাকি এবার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে আসবে। প্রথমে ভাবলাম রোনালদো আসলে আসুক, তাতে আমার কি? কিন্তু তারপর শুনলাম যে বার্সেলোনাকে আটকানোর আশায় তাকে নাকি রিয়াল মাদ্রিদ দলে এনেছে। লোকমুখে শুনলাম এই রোনালদো নাকি নিজেকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় বলে, সে নাকি মেসি থেকেও ভালো। রোনালদো নিজে এই কথা বলেছে নাকি লোকমুখে ছড়ানো গুজব ছিল এটা তা নিয়ে ভাববার মত পরিপক্কতা তখন আমার ছিল না।

এই নতুন রোনালদো আমার আগে থেকেই তেমন একটা পছন্দ ছিল না। এবারতো সে হয়ে গেল আমার চক্ষুশূল। রোনালদো যেন কখনোই মেসি থেকে ভালো না করতে পারে, রিয়াল মাদ্রিদ যেন কোনো কিছুই না জিততে পারে সেই দোয়া করলাম খোদার কাছে।

আমার করা এই দোয়া মনে হয় কাজে লেগেছিল। ২০০৯-১০ মৌসুমে বার্সেলোনা যেখানে ৪টা কাপ জিতেছিল সেখানে রোনালদোর রিয়াল জিততে পারেনি কিছুই। আর সেইবছর মেসির ব্যালন ডি অর জিতা ছিল আমার জন্য সোনায় সোহাগা।

কিন্তু ২০০৯-১০ মৌসুমের ব্যালন ডি অর জেতাতো ছিল সবে সূচনা। তারপরের তিনটি মৌসুমেও মেসি ইউরোপ তথা বিশ্বের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার নিজের বগলদাবা করে নেয়। যদিও এই তিন মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের শিরোপা খরা কিছুটা কাটে। ২০১১-১২ মৌসুমের লিগ শিরোপাও রিয়াল জিতে নেয়। তারপরও বার্সেলোনার আধিপত্য এবং তার থেকেও বড় কথা রোনালদোর উপর মেসির আধিপত্য দেখে আমি খুশি ছিলাম। প্রতি বছর রোনালদোর ব্যালন ডি অর নেয়ার জন্য যাওয়া ও খালি হাতে ফিরে আসার দৃশ্য দেখে এক পৈশাচিক আনন্দ পেতাম।

টানা চারবার ব্যালন ডি অর জেতা মেসি তখন আমার চোখে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার। রোনালদো ছিল তার থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে। আমি ভাবলাম এখন এই পর্তুগীজ রোনালদো নিজেকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় দাবি করা বন্ধ করবে আর মেসির শ্রেষ্ঠত্বের কাছে হার মেনে নিবে। কিন্তু এবার রোনালদো আমাকে চমকে দেয়া শুরু করল।

২০১৩-১৪ মৌসুম থেকে রোনালদোর ভাগ্যফেরা শুরু করল। মেসি রোনালদো যুগে প্রথমবারের মত শিরোপার সংখ্যায় রিয়াল বার্সেলোনাকে হারিয়ে দিল। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের লিগ শিরোপা জয়ের বছরে রিয়াল মাদ্রিদ জিতে নিল তাদের আরাধ্য ১০ম চ্যাম্পিয়নস লিগ। রিয়ালের চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতায় যে দুঃখ পেয়েছিলাম তার থেকেও বেশি দুঃখ লেগেছিল যখন দেখলাম ব্যালন ডি অর মেসির হাত থেকে চলে গিয়েছে রোনালদোর কাছে। সেটা ছিল রোনালদোর নিজের ক্যারিয়ারের ২য় ও রিয়ালের হয়ে ১ম ব্যালন ডি অর।

পরের বছর বার্সেলোনা আবার দুর্দান্ত প্রতাপে ফিরে এসে একইসাথে লিগ শিরোপা ও চ্যাম্পিয়নস লীগ জিতে নিল। কিন্তু তারপরও ব্যালন ডি অর রয়ে গেল রোনালদোর কাছে।

২০১৫-১৬ মৌসুমে একাদশবারের মত চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে নিল রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু এবার ব্যালন ডি অর ফিরে আসল মেসির কাছে। ৫ম বারের মত ব্যালন ডি অর জিতে গেল মেসি।

মেসির ৫ম ব্যালন ডি অর পাওয়ার পরই আমার চোখে মেসি রোনালদো দৈরত্বের সমাপ্তি হয়ে গিয়েছে। ৩০-এ পা দেয়া ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তার থেকে দুই বছরের ছোট মেসিকে আর ছাড়িয়ে যেতে পারবে না বলে মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। অনেক হয়েছে, আর না। এবার থেকে শুরু হবে মেসির একক রাজত্ব অথবা নতুন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আসবে মেসির সামনে। কিন্তু আরো একবার আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল।

পরের বছর আবারো ফিরে আসলেন রোনালদো। রিয়াল মাদ্রিদ লিগ শিরোপার পাশাপাশি টানা ২য়বার জিতে নিল চ্যাম্পিয়নস লিগ। ২০১৬ সালে রোনালদো তার জাতীয় দল পর্তুগালের হয়ে জিতে গেলেন ইউরো। তাই সেই মৌসুমে মেসির ব্যক্তিগত পারফর্মেন্স রোনালদো থেকে ভালো হওয়া সত্ত্বেও ব্যালন ডি অর আবারো চলে যায় রোনালদোর কাছে।

রোনালদোর এই কীর্তিতে আমার মত অনেকেই চমকে যায়। তখন ভাবলাম এটাই হয়তোবা রোনালদোর ক্যারিয়ারের শেষ বড় ঝলক। আবারো মনে মনে দেখে ফেলেছিলাম রোনালদোর সমাপ্তি। কিন্তু ‘বুড়ো’ রোনালদো আমার মত নিন্দুকদের আরো একবার বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে রিয়ালের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতবার হ্যাট্রিক করে ফেলল। আবার জিতে নিল ব্যালন ডি অর।

রোনালদোর ক্যারিয়ারের সবথেকে বড় হলমার্ক মনে হয় এটাই। তাকে যতবার আপনি বাতিলের খাতায় ফেলার চেষ্টা করবেন সে ততবার আরো দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। তাকে মানসিক লড়াইয়ে হারানো অসম্ভব। হার মেনে নেয়া যেন রোনালদোর চিত্তেই অনুপস্থিত।

মেসি যেখানে ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা নিয়ে ফুটবল বিশ্বে রাজত্য করে বেড়াচ্ছে, সেখানে রোনালদো নিজের পরিশ্রম, হার না মানা মানসিকতা ও প্রচন্ড জেদের সাহায্যে প্রতিনিয়ত অসম্ভবকে সম্ভব করে চলেছে।

রোনালদোর নিজের প্রতি এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস অনেকের চোখেই তার দাম্ভিকতা। কিন্তু নিজের ক্ষমতার প্রতি এই অতিরিক্ত আস্থার কারণেই রোনালদো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে।

“এমন অনেক মানুষ আছে যারা আমাকে ঘৃণা করে। তারা বলে আমি নাকি কোন কাজের না, আমি অহংকারী এটা-সেটা আরও কতো কি! কিন্তু আমি মনে করি এসবও আমার সাফল্যেরই অংশ। আমি জন্মেছি সেরা হওয়ার জন্য। আমি এভাবেই চিন্তা করি এবং এ জন্য যদি ফুটবলে আমার সব অর্জনই ধূলিসাৎ হয়ে যায়, তাতেও আমি নিজেকে এক চুল পরিমাণ বদলাবো না।”

২০১৬ সালে স্প্যানিশ পত্রিকা এল মুন্ডোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো

২০১৮ বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার আগেই রোনালদো রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে যোগ দিয়েছেন জুভেন্টাসে। আমি কখনো রোনালদো ফ্যান ছিলাম না, সত্যি বলতে এখনো আমি রোনালদো ফ্যান না। কিন্তু রোনালদোর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস, খেলার প্রতি তার ডেডিকেশন আর সেরা হওয়ার জন্য তার আপ্রাণ চেষ্টাকে আমি এখন শ্রদ্ধা করি। রোনালদোর রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে যাওয়ার পেছনেও কাজ করেছে তার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদের পর এবার জুভেন্টাসের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলারদের তালিকায় মেসিকে ছাড়িয়ে যেতে চান রোনালদো। নিজের নতুন অভিযানে কতটুকু সফল হতে পারবেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তা সময়ই বলবে। এক প্রাক্তন রোনালদো হেটারের পক্ষ থেকে নতুন অভিযানের জন্য শুভকামনা রইল রোনালদোর প্রতি। আরো একবার চমকে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

Post Author: Ashfaq Niloy

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *