রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন-এর আলাপচারিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন দুটি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, ভাষা, ধর্ম, দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একে অন্যের থেকে ভিন্ন। রবি ঠাকুর ছিলেন বিশ্বনন্দিত এক সাহিত্যিক আর আইনস্টাইন বিজ্ঞানের জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তাদের মাঝে এত শত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার কোনো অভাব ছিল না। একে অন্যের মেধাকে তারা মান্য করতেন। এভাবেই তাদের মাঝে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

রবি ঠাকুর ও আইনস্টাইন-এর মোট ৪ বার সাক্ষাৎ হয়। প্রথমবার এ দুইজন মহারথীর সাক্ষাৎ হয় ১৯২৬ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর। রবীন্দ্রনাথ তখন জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। তাঁর সম্মানে জার্মানির সংস্কৃতি মন্ত্রী একটি চা-চক্রের আয়োজন করেন। সেখানেই রবীন্দ্রনাথ-এর সাথে আইনস্টাইন-এর প্রথম দেখা হয়। একইদিন বিকেল বেলায় আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর বাসভবন ‘আইনস্টাইন ভিলা’-তে নিয়ে যান এবং আতিথেয়তা করেন। সেখানে তাদের মধ্যে সত্য, বিশ্বজগৎ ও মনুষ্য চেতনা নিয়ে আলোচনা হয়। সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইনস্টাইন-এর জামাতা, বিখ্যাত সাংবাদিক দিমিত্রি মারিয়ানফ্। তিনিই রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন-এর মধ্যকার আলাপের অংশবিশেষ ১৯৩০ সালের ১০ই আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় “Einstein and Tagore plumb the truth” শিরোনামে প্রকাশ করেন। তাদের আলাপচারিতার চুম্বক অংশের অনুবাদ আজকে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি।

রবীন্দ্রনাথ: আপনি গণিত শাস্ত্রের দুটো প্রাচীন সত্তা; স্থান এবং কাল-এর অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। আর আমি এদেশে চিরন্তন মানবসত্ত্বা ও বাস্তন জগৎ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বেরাচ্ছি। 

আইনস্টাইন: আপনি ঐশী শক্তিকে বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন বলে বিশ্বাস করেন?

রবীন্দ্রনাথ: বিচ্ছিন্ন করে নয়। মানুষের অনন্ত ব্যক্তিসত্ত্বা বিশ্ব প্রকৃতিকে অনুধাবন করে। এমন কিছুই নেই যা মানবসত্ত্বা বুঝতে অপারগ এবং এটাই প্রমাণ করে যে বিশ্বজগতের সত্যই মানবসত্ত্বার সত্য।

আইনস্টাইন: মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্বন্ধে দুটো ধারণা রয়েছে। প্রকৃতি মানবিকতার উপর নির্ভরশীল অথবা প্রকৃতি সকল ধরনের মানবিক কার্যকারণ থেকে স্বনির্ভর।

রবীন্দ্রনাথ:মহাবিশ্ব যখন মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে যায়, তখনই তা আমরা পরম সুন্দর ও সত্য হিসেবে অনুভব করি।

আইনস্টাইন: এটা পুরোপুরি মানবনির্ভর বিশ্বজগৎ ধারণা।

রবীন্দ্রনাথ: এই জগৎ হচ্ছে মানবিক জগৎ, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যে বিশ্বকে আমরা দেখতে পাই তাও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরই জগৎ। অতএব আমাদের কাছ থেকে জগৎকে সরিয়ে রাখলে জগতের অস্তিত্ব থাকে না। এটা একটা আপেক্ষিক জগৎ এবং এর বাস্তবতা আমাদের চৈতন্যনির্ভর। কিছু আদর্শিক কার্যকারণ এবং উপভোগের মাধ্যমে আমাদের কাছে এই সত্য উপস্থাপিত হয়। আমাদের লব্ধ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরম মানবতা তাঁর অভিজ্ঞতা লাভ করে।

আইনস্টাইন: এটি মানবসত্ত্বার উপলব্ধি।

রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, এটি একটি পরম উপলব্ধি। একে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে আমাদের আবেগ এবং কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। এভাবেই আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা থেকেও অসীম মানবসত্ত্বাকে উপলব্ধি করতে পারব।

বিজ্ঞান ব্যক্তির কাছে সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞান ব্যক্তিসত্ত্বার বাইরে যেয়ে সত্যকে অনুসন্ধান করতে ব্যস্ত। ধর্ম এসকল সত্যকে বাস্তবায়িত করে এবং আমাদেরকে নিজেদের গভীর প্রয়োজনসমূহের সাথে সংযোগ ঘটায়। আমাদের ব্যক্তিগত সত্যের সজ্ঞানতা বিশ্বজনীন মূল্য লাভ করে। ধর্ম সত্যের মূল্যকে প্রয়োগ করে এবং আমরা এর সাথে নিজেদের মিলটাকে সুসমন্বিত করে সত্যকে মঙ্গলময় হিসেবে জানতে পারি।

আইনস্টাইন: সত্য তারপর সৌন্দর্য, এগুলো কি মানুষ থেকে স্বনির্ভর নয়?

রবীন্দ্রনাথ: না।

আইনস্টাইন: যদি মানব জাতির কেউ না থাকতো, তাহলে কি বেলভিডিয়ারের অ্যাপোলো সুন্দর বিবেচিত হতো না?

রবীন্দ্রনাথ: না।

আইনস্টাইন: সৌন্দর্যবোধের এই ধারণা সম্পর্কে আমি আপনার সাথে একমত, কিন্তু সত্য সম্পর্কে একমত নই।

রবীন্দ্রনাথ: কেন? সত্য তো মানুষের মাধ্যমেই উপলব্ধির যোগ্য হয়ে উঠে।

আইনস্টাইন:  আমার ধারণা যে ঠিক, সে বিষয়ে আমি কোনো প্রমাণ দিতে পারব না। কিন্তু এটাই আমার ধর্ম। 

রবীন্দ্রনাথ: সৌন্দর্য হলো তাই যা বিশ্বসত্ত্বার সাথে একাত্ম। সত্য হলো বিশ্বসত্ত্বার মননশীলতার যথার্থ উপলব্ধি। এ ছাড়া আমরা কি ভাবে সত্যকে চিনতে পারবো?

আইনস্টাইন: আমি প্রমাণ করতে পারবো না। কিন্তু আমি পিথাগোরাসের উপপাদ্যে বিশ্বাসী, যে সত্য মানব নির্ভরতামুক্ত। এটা অবিচ্ছিন্ন যুক্তির সমস্যা।

রবীন্দ্রনাথ: সত্যকে মানবতার সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্যথায় আমরা কেউই সত্যকে অনুভব করতে পারব না। সত্য বর্ণিত হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে, শুধুমাত্র যৌক্তিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তার কাছে পৌঁছানো যাবে। নাহলে সেটা হয়ে যাবে শুধুমাত্র মানব মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা। ভারতীয় দর্শন অনুসারে ব্রহ্মই পরম সত্য। যাকে কোনো ব্যক্তি নিজে থেকে উপলব্ধি করতে পারবে না বা শব্দ দ্বারা লিপিবদ্ধ করতে পারবে না। এই পরম সত্যকে উপলব্ধি করা যেতে পারে অসীমের সাথে ব্যক্তিসত্ত্বার মিলনের মাধ্যমে। কিন্তু এই ধরনের সত্য বিজ্ঞান জগতের নয়। আমরা এখানে যে সত্যের আলোচনা করছি তা হল মানুষের মনের সত্য। যেহেতু এটা মানবিক একে মায়া বা বিভ্রম বলা যেতে পারে।

আইনস্টাইন: আর এই বিভ্রম কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, এটা সমগ্র মনুষ্য প্রজাতির বিভ্রম।

রবীন্দ্রনাথ: পুরো মনুষ্য প্রজাতি মানবতার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ। সেই জন্য সমগ্র মানবসত্ত্বা সত্যকে একইভাবে উপলব্ধি করে, ভারতীয় বা ইউরোপীয় মননে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। 

ইনস্টাইন: প্রজাতি শব্দটি জার্মান ভাষায় সকল মনুষ্যসত্তাকে বুঝায়। সত্যি কথা বলতে কি, বানর কিংবা ব্যাঙও এর ভিতরে পরে। মূল প্রশ্নটি হলো, সত্য কি মানবসত্ত্বা থেকে স্বাধীন নাকি তাঁর উপর নির্ভরশীল সেটা।

রবীন্দ্রনাথ: যাকে আমরা সত্য বলে জানি, তা বাস্তবতার সকল বিষয়ের যৌক্তিক সমন্বয়ে সৃষ্ট এক সত্য যাকে একমাত্র পরম ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারবে।

আইনস্টাইন: আমরা আমাদের মনোজগতে যা ভাবি, এমনকি প্রাত্যহিক জীবনে যা করি, তার জন্য আমরা দায়ী নই। আমাদের এসব কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ করে বাহ্যিক বস্তুসমূহ, যা সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, ঘরে কেউ না থাকলেও টেবিলটি যেখানে ছিল সেখানেই থাকবে। কেউ যদি বাড়িতে নাও থাকে, তাহলেও টেবিলটির অস্তিত্ব থাকবে। কিন্তু ইতিমধ্যে তা আপনার দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। এই কারণে টেবিলটা যে আছে তা ব্যাখ্যা বা প্রমাণ করা সম্ভব না। মানবতা নিরপেক্ষ সত্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের স্বাভাবিক বোধ ব্যাখ্যা কিংবা প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু এই বিশ্বাস কেউ ত্যাগ করতে পারে না, আদিম মানুষেরাও তা করতে পারে নি। সত্যকে আমরা আমাদের অস্তিত্ব, অভিজ্ঞতা এবং মানস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত বলে মনে করি। যদিও সেই সত্য কিরকম হতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই।

রবীন্দ্রনাথ: সে যাই হোক, যদি কোনো সত্য থেকে থাকে যার সঙ্গে মানবিকতা সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন, তবে তা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন।

আইনস্টাইন: তাহলে  তো দেখা যাচ্ছে যে আপনার চেয়ে আমি বেশি ধার্মিক!

রবীন্দ্রনাথ: আমার ধর্ম হচ্ছে আমার মনে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবসত্তাকে সম্পূর্ণভাবে ধারণ করা।

 

তথ্যসূত্রঃ

New York Times, August 10, 1930, by Dmitri Marianoff

সংগীতচিন্তা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতী। ২৫ বৈশাখ ১৩৯২। 

http://www.onushilon.org/corpus/robi/robi-ein.htm

Post Author: Ashfaq Niloy

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *