আমাদের সমাজ নারীদেরকে আমরা শুধু মমতাময়ী, স্নেহদাত্রী হিসেবেই কল্পনা করতে চায়। তাদেরকে হেঁশেলের মধ্যে বেঁধে রাখতেই আমরা ব্যস্ত। নারীও যে পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনে অস্ত্রধারণ করতে সক্ষম তা আমরা মানতে নারাজ। সমাজের এই সঙ্কীর্ণ চিন্তাধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যে মহীয়সী নারী ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশের জন্য করেছেন আত্মহুতি, তাঁর নাম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। আজকে এই মহান বিপ্লবী নারীর ১০৭তম জন্মবার্ষিকী। আজকের এইদিনে এই মহান বিপ্লবীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর জীবন ও বীরত্বগাথা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলতে চাচ্ছি।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ই মে মঙ্গলবার চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা প্রতিভাদেবী। প্রীতিলতা ছিলেন ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। তাঁদের পরিবারের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোন এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে “ওয়াহেদেদার” উপাধি পেয়েছিলেন, এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার। প্রীতিলতাকে আদর করে মা প্রতিভাদেবী ‘রানী’ বলে ডাকতেন।
লাজুক, অন্তর্মুখী ও মুখচোরা স্বভাবের প্রীতিলতা ছিলেন খুব মেধাবী। ছোট বয়সেই মেয়ের মেধাকে চিনতে পেরে তাঁর পিতা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার তাঁকে ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করান। সেখান থেকে ১৯২৮ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন৷ তারপর তিনি ভর্তি হন ঢাকার ইডেন কলেজে। কলেজের ছাত্রীনিবাসেই তাঁর পরিচয় হয় বিপ্লবী লীলা নাগের সাথে। লীলা নাগ ঢাকার বিপ্লবী দল শ্রীসংঘের নারী শাখা দীপালি সংঘের নেতৃত্বে ছিলেন। লীলা নাগের দিক নির্দেশনায় প্রীতিলতা বিপ্লবে প্রথম অংশগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন৷ তারপর তিনি ভর্তি হন কলকাতার বেথুন কলেজে। ১৯৩২ সালে প্রীতিলতা সেখান থেকে স্নাতক শ্রেণির পরীক্ষায় অংশ নেন৷
ছোটবেলা থেকেই প্রীতিলতার ইংরেজ বিরোধী বিপ্লব এবং বিপ্লবীদের জীবন নিয়ে আগ্রহ ছিল। মহারানী ঝাঁসিবাই-এর জীবনী তাঁকে বিপ্লবী জীবনের দিকে আকৃষ্ট করে। লীলা নাগের সংস্পর্শে আসার পরে তিনি বিপ্লবে সরাসরি অংশগ্রহণের পথ খুঁজে পান। লীলা নাগ প্রীতিলতার মধ্যে বিপ্লবে অংশগ্রহণের প্রবল ইচ্ছা দেখতে পেয়ে তাঁর হাতে দীপালি সংঘের সদস্য ফর্ম তুলে দেন। এভাবেই প্রীতিলতা বিপ্লবীদের দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পরেন।
১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেন-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে সংঘটিত হয় এক অবিস্মরণীয় বিদ্রোহ। বিপ্লবীরা একইসঙ্গে আক্রমণ করে চট্টগ্রামের সরকারি অস্ত্রাগার লুন্ঠন, রিজার্ভ পুলিশ ছত্রভঙ্গ, টেলিগ্রাফ-টেলিফোন বিকল ও রেললাইন উপড়ে ফেলে। চট্টগ্রাম একপ্রকার ইংরেজ শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। সিপাহি বিদ্রোহের পর সেবারই প্রথম ইংরেজ শাসন এত প্রবল সশস্ত্র বিপ্লবের সম্মুখীন হয়। এই বিদ্রোহ চলার সময়ে প্রীতিলতা কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। বিপ্লবে অংশ নেয়ার জন্য তিনি উদগ্রীব ছিলেন। কিন্তু মাস্টারদার আদেশ না আসায় সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নিতে পারেননি প্রীতিলতা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় আরো ২ বছর।
১৯৩০ সালের চট্টগ্রামের যুব বিপ্লবের একটি অন্যতম লক্ষ্য ছিল পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ। কিন্তু গুড ফ্রাইডের কারনে সেদিনের ঐ পরিকল্পনা সফল করা যায়নি। চট্টগ্রাম শহরের উত্তরদিকে পাহাড়তলী স্টেশনের কাছে এই ক্লাব ছিল ব্রিটিশদের প্রমোদকেন্দ্র। পাহাড় ঘেরা এই ক্লাবটি নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকত। শ্বেতাঙ্গরা ব্যতীত এবং ক্লাবের কর্মচারী, বয়-বেয়ারা, দারোয়ান ছাড়া ভারতীয় কেউ ঐ ক্লাবে প্রবেশ করতে পারত না। ক্লাবের সামনের সাইনবোর্ডে লেখা ছিল “Dogs and Indians not allowed”। সন্ধ্যা হতেই ইংরেজরা এই ক্লাবে এসে মদ খেয়ে নাচ, গান এবং আনন্দ উল্লাস করতো। মাষ্টারদা ১৯৩২ এর সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে প্রীতিলতার উপর।
২৩ সেপ্টেম্বর আক্রমণের দিন ধার্য হয়। আক্রমণের সময় প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবী, চুল ঢাকা দেবার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবীদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবী ছেলেদের মত পোশাক পড়ানো হয়েছিল। সে দিনের আক্রমনে প্রীতিলতার সাথে ছিলেন কালীকিংকর দে, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, শান্তি চক্রবর্তী, মহেন্দ্র চৌধুরী, পান্না সেন এবং সুশীল দে। বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা ক্লাবের কর্মচারী যোগেশ মজুমদার ক্লাবের ভিতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ এর দিকে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরেই আক্রমণ শুরু হয়। সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাবে আক্রমণ করে। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেবার সাথে সাথেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে উঠে। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাবার কারনে সবাই অন্ধকারে ছুটোছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার ছিল। তাঁরা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারী অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতা বাঁ-পাশে গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয় এবং চারজন পুরুষ এবং সাত জন মহিলা আহত হয়।
প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটার সাথে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। গুলিবিদ্ধ প্রীতিলতা ইংরেজদের হাতে আটক হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি নির্দেশ দেন অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে। লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবীরা শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে। সেখানেই বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু ঘটে।
সেদিন পাহাড়তলিতে প্রীতিলতার দেহবসান হয়। কিন্তু এই মৃত্যু তাঁকে অমরত্ব দান করে। আজও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কাছে তিনি বীরত্বের প্রতীক। তাঁর বীরত্বের ও ত্যাগের স্মৃতি চিরকাল বাঙ্গালিদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।